অভ্যাস
অভ্যাস (Habit) হলো একধরনের আচরণ যা নিয়মিত পুনরাবৃত্তি করা হয়। এই আচরণ একটি কাজ, একটি রুটিন বা একটি জীবনধারাও হতে পারে। অভ্যাস হলো একটি আচরণগত প্যাটার্ন যা আমরা প্রায়শই পুনরাবৃত্তি করি, বা নিয়মিত বিরতিতে করি। অভ্যাস আমাদের জীবনের খুবই ক্ষমতাশালী একটি বিষয়। কারণ অভ্যাস প্রতিনিয়ত, দিন-রাত, প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের তুলে ধরে। এটা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে। একটি কাজ নিয়মিত বারবার করতে থাকলে সেটা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। নিত্যনৈমত্তিক কাজ, মুদ্রা দোষ, সন্দেহ প্রবণতা, টিজ করা ইত্যাদি অভ্যাসের উদাহরণ। প্রেমের সম্পর্কের শুরুও হয় অভ্যাস থেকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
![]() |
অভ্যাস (Habit) |
মস্তিষ্কের সংকেত অনুযায়ী মনে কোন একটি কাজ করার আকাঙ্খা তৈরি হলে বা বাধ্য হয়ে কোন কাজ বারবার করলে একটি অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। অভ্যাস যেভাবে গড়া যায়, একইভাবে ভাঙ্গাও যায়, নতুন করে তৈরি করা যায়, আবার পাল্টানোও যায়। তবে নতুন অভ্যাস তৈরি করতে ও পাল্টাতে সময় লাগে, এটা হুট করেই হয়ে যায় না। এমন নয় যে, কাল সকাল থেকেই আপনি আপনার একটা অভ্যাস পাল্টে ফেলতে পারবেন। অভ্যাস পাল্টাতে হলে বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
অভ্যাস কত প্রকার ও কি কি?
অভ্যাস সাধারণত ৭ প্রকার। অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ ভিন্নমতও পোষণ করেছেন তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞগণ ৭ প্রকারই মনে করেন।
টাইপ ১: শারীরিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস
এই ধরনের অভ্যাস শরীরের সাথে সম্পর্কিত। দূর্বল স্বাস্থ্যের ফলে শরীরে শক্তির মাত্রা এবং আত্ম-সম্মান কমে যায়। তাই বিশেষজ্ঞগণ একটি নতুন স্বাস্থ্য অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। রোগ প্রতিরোধের সাধারণ অভ্যাস চর্চা আমাদের শরীর ও মনকে শান্ত ও সুন্দর রাখতে সহায়তা করে। নিয়মিত সময়ে বিছানায় যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা, কমপক্ষে ৭ ঘন্টা উচ্চ মানের ঘুম, বাইরের খাবারের পরিবর্তে বাড়ীতে রান্না করা খাবার গ্রহণ, অস্বাস্থ্যকর সবকিছুর বদলে স্বাস্থ্যকর বিকল্পের ব্যবহার, কমপক্ষে ৩০ মিনিটের দৈনিক ব্যায়াম রুটিন ইত্যাদি হলো শারীরিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস। সূস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস গড়তে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
টাইপ ২: মানসিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস
কীভাবে চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং আবেগগুলো পরিচালনা করতে হয় শেখার জন্য নিজেকে নিয়ে সময় কাটানো, মেডিটিয়েশন, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অবজারবেশন, পজিটিভ মাইন্ড, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি হলো মানসিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস। একটি সূস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্যের অভ্যাস গড়তে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
টাইপ ৩: সামাজিক অভ্যাস
আমরা সামাজিক প্রাণী, এবং আমাদের সংযোগ প্রয়োজন। সমমনা লোকদের সাথে অর্থপূর্ণ কথোপকথনের অভ্যাস করা প্রয়োজন। নতুন, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি হলো সামাজিক অভ্যাস। যারা বহির্মুখী তাদের সামাজিক অভ্যাসগুলো স্বয়ংক্রিয় কিন্তু যারা অন্তর্মুখী তাদের, অন্যদের সাথে সংযোগ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা উচিত। এমনকি যদি এর জন্য কমফোর্ট জোনের বাইরেও যেতে হয় তবুও যাওয়া উচিত।
টাইপ ৪: সময়ের অভ্যাস
এই অভ্যাসটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ মানুষ খুব বেশি সময়ের অপচয় করে। মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে কতবার সময় নষ্ট করে? কত ঘন্টা বেকার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্ক্রোল করে? কতবার অন্যান্য আনন্দহীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়? যে কাজের তেমন কোন গুরুত্ব নেই তবুও ঐ কাজে অযথা ব্যস্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এড়িয়ে যায়। এই অযথা অপ্রয়োজনীয় কাজের মাধ্যমে সময় অপচয়ের অভ্যাস পরিবর্তন করা আবশ্যিক।
টাইপ ৫: ক্যারিয়ারের অভ্যাস
ক্যারিয়ার গঠনের গতানুগতিক অভ্যাস যেমন স্কুল-কলেজ শেষে রুটিন অনুযায়ী স্টাডি বা সারামাস চাকরিতে একই সিডিউলে কাজ করে মাস শেষে স্যালারি পাওয়া, এইগুলো হলো গতানুগতিক অভ্যাস। এমন অভ্যাস করা যেতে পারে যা চলমান ক্যারিয়ায়ের থেকেও অনেক বেশি সুখের ও সাফল্যের। জীবনের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি একটি লক্ষ্য থাকা দরকার। জীবনের মিশন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লক্ষ্য পর্যালোচনা করার অভ্যাস, ক্রমাগত নতুন দক্ষতা শেখার, জ্ঞান অর্জন করার অভ্যাস যা আপনাকে লক্ষ্য পূরণের দিকে পরিচালিত করে। এগুলোই হলো ক্যারিয়ারের অভ্যাস। ক্যারিয়ারের অভ্যাস সবার জীবনের স্বপ্নপূরনের পথে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
টাইপ ৬: আর্থিক অভ্যাস
অর্থ সুখ কিনতে পারে না। এটি সত্য হলেও, অর্থ না থাকা অবশ্যই জীবনের মানকে প্রভাবিত করে এবং কখনও কখনও অত্যন্ত বিপর্যয়কর পরিণতির বয়ে আনে। তাই প্রত্যেকেরই আর্থিক স্বাধীনতার লক্ষ্য থাকা উচিত। অধিকাংশ মানুষ আর্থিকভাবে সংগ্রাম করে। অনেক সংগ্রাম করেও আর্থিকভাবে উন্নতি করতে পারেনা। এর কারন হলো মানুষের আর্থিক অভ্যাসের কৌশল জানা নেই। সাফল্য এবং সুখের জন্য সর্বোত্তম জীবন যাপন করার জন্য মৌলিক আর্থিক অভ্যাস প্রয়োজন।
আর্থিক অভ্যাসের কিছু কৌশল
- উপার্জনের চেয়ে কম ব্যয় করা- যে যতই উপার্জন করুন না কেন, উপার্জনের চেয়ে বেশি ব্যয় করলে কখনই আর্থিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করা যাবেনা। তাই উপার্জনের চেয়ে কম ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
- খারাপ দিনের জন্য আয়ের কিছু অংশ সংরক্ষণ করা- এই অভ্যাস আকস্মিক বিপদে তাৎক্ষনিকভাবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিবে।
- জীবনযাত্রার খরচ কমানোর অভ্যাস- ছোট বাড়িতে বা একটি জায়গা নির্বাচন বা সাবলেট ইত্যাদি জীবনযাত্রার খরচ কমাতে পারে, তাছাড়া আরো অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
- উপার্জন বৃদ্ধির অভাস- এটা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশভেদে উপার্জন বাড়ানের অনেক উপায় বের করা যায়। নিজের স্কিলগুলোর মাধ্যমে অবসর বা অপচয় করা সময়ের পূর্ণ ব্যবহার করে উপার্জন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
- বেশি উপার্জন, কম খরচ বা উভয়ই করার অভ্যাস।
- উপার্জন ও খরচের হিসাব করার অভ্যাস- এই কাজটির অভ্যাস করা খুবই গুরুত্তপূর্ণ। এর মাধ্যমেই আয়, ব্যয় ও সেভিংস বুঝতে পারা যায়।
টাইপ ৭: আধ্যাত্মিক এবং অবদানের অভ্যাস
জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে আধ্যাত্মিক এবং অবদানের অভ্যাস অতি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, উপকার করা, সদুপদেশ দেওয়া, অন্যদের প্রচেষ্টার ফলকে স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি হলো আধ্যাত্মিক অভ্যাস। আধ্যাত্মিক অভ্যাসের পাশাপাশি পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, পৃথিবীতে ব্যক্তির অবদান রাখা প্রয়োজন। অবদান মানুষের মনেকে শান্ত ও পবিত্র করে। সময়, অর্থ, শক্তি, সম্পদ ইত্যাদি মূল্যবান দান আর এরমধ্যে সময় হলো সবচেয়ে মূল্যবান। দানের মাধ্যমে অবদান রাখার অভ্যাস মানুষের জীবনকে উন্নত করে। তাই সবারই আধ্যাত্মিক এবং অবদানের অভ্যাস করা উচিত।
একটি অভ্যাস গঠন
একটি অভ্যাস কিভাবে গঠিত হয় জানতে হলে অভ্যাস লুপ সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। অভ্যাস লুপের মাধ্যমেই একটি অভ্যাস গঠিত হয় আবার একটি অভ্যাসকে পরিবর্তন করা যায়। নিম্নে অভ্যাস লুপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
অভ্যাস লুপ (Habit Loop)
মস্তিষ্ক সর্বদা কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য কার্যকর উপায় অনুসন্ধান করে। মস্তিষ্কের চক্র হিসাবে একটি অভ্যাস লুপ গঠন করে এবং কাজগুলোকে সহজ করার জন্য তথ্য সংরক্ষণ করে। এই লুপ কীভাবে ঘটে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে কিছু অভ্যাস মানুষের জীবনে সমস্যাযুক্ত হয়ে ওঠে তা চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যাস লুপগুলো কার্যকর কারণ তারা নতুন প্যাটার্ন এবং রুটিন তৈরি করতে আমাদের মস্তিষ্কের সাথে কাজ করে। যখন আমরা একটি রুটিন তৈরি করতে চাই, তখন আমরা প্রায়শই মনে করি আমাদের পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পথ তৈরি করতে হবে।
অভ্যাস লুপের ধারণাটি চার্লস ডুহিগ তার ২০১২ সালে ‘The Power of Habit’ বইতে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তার গবেষণায়, ডুহিগ দেখেছেন যে অভ্যাস গঠনের তিনটি মূল অংশ রয়েছে। একটি অভ্যাস লুপের ৩টি অংশ। যথা- ১। কিউ (Cue), ২। রুটিন (Routine) এবং ৩। পুরষ্কার (Reward)।
১। কিউ (Cue)
একটি অভ্যাস লুপের সূচনা হল যা শুরু করার জন্য অভ্যাসটিকে ট্রিগার করে৷ কিউ হল ট্রিগার যা অভ্যাসগত আচরণকে প্রভাবিত করে। যে ইঙ্গিতগুলো রুটিন আচরণ বা অভ্যাসকে প্ররোচিত করে তা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কিউ অভ্যাসকে গতিশীল করে। কোন কিছু অভ্যাসে পরিণত করতে একটি কাজের রুটিন সেট করতে হয় এবং ঐ রুটিন অনুযায়ী কাজ করতে ট্রিগার সেট করা প্রয়োজন। এটি সকালের ঘুম থেকে ওঠার রুটিনের মতো হতে পারে, যা আপনার অ্যালার্ম ঘড়ি দ্বারা ট্রিগার হয়। অ্যালার্ম ঘড়ি বাজতে শোনার পরে, আপনি আপনার বিছানা থেকে জেগে উঠতে ট্রিগার করেন তারপর একটি সেট রুটিন অনুযায়ী এগিয়ে যান। সমস্ত অভ্যাসের কোনো না কোনো ধরনের ট্রিগার থাকবে, ট্রিগারটি সুস্পষ্ট শারীরিক ইঙ্গিত হোক বা কম সুস্পষ্ট মানসিক ইঙ্গিত হোক। কোন একটি রুটিনে যদি নির্দিষ্ট ট্রিগার না থাকে, তাহলে আপনি এলোমেলোভাবে একটি অভ্যাসের সাথে জড়িত হবেন। এমন এলোমেলো পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হতে পারে। এইভাবে, ট্রিগার সম্পর্কে সচেতন হয়ে আপনি যখন একটি অভ্যাস তৈরি করতে শুরু করেন। এটি আপনাকে সঠিকভাবে একটি অভ্যাস শুরু করতে সাহায্য করবে।
ট্রিগার মানুষের জুতা পড়া থেকে শুরু করে, হাঁটা, মাদুর বিছানো, যোগব্যায়াম পর্যন্ত যেকোনো কিছুই হতে পারে। ডুহিগের মতে, যেসব ইঙ্গিত দ্বারা ট্রিগার করা যেতে পারে: সময়, অবস্থান, বর্তমান মানসিক অবস্থা, আপনার চারপাশের মানুষ ও আপনার শেষ অ্যাকশন। উদাহরণ-
- সময়ঃ সময় অনেক অভ্যাস গঠন তৈরি করে। এটি অনেক সামাজিক, কর্মক্ষেত্র এবং বাড়ির সাথে সম্পর্কিত আচরণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। সকাল ৯টা, অফিসে হাজিরা দেওয়ার সময়।
- অবস্থানঃ অবস্থান ব্যক্তিদের জন্য শক্তিশালী সংকেত। মানুষ যদি ট্রমা ভোগ করে, যে জায়গায় এটি ঘটেছে বা অনুরূপ পরিবেশে একটি আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
- মানসিক অবস্থা বা আবেগঃ আবেগ অভ্যাস গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি। মানুষ ক্ষুধার্ত না থাকা সত্ত্বেও মানসিক ট্রিগারের কারণে অতিরিক্ত খেতে পারে। দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের সব ধরনের মানসিক সংকেত থাকে যা অভিভূত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- চারপাশের মানুষেরাঃ অন্য মানুষের ক্রিয়া অভ্যাস কিউ গঠনকে প্রভাবিত করে। সোশ্যাল মিডিয়া একাকীত্ব, অপ্রতুলতা এবং অসন্তোষকে বাড়িয়ে দিয়ে অনেক উদ্বেগকে উস্কে দেয়।
- শেষ অ্যাকশনঃ আমি এইমাত্র বাড়ী ফিরেছি, তাই এখন আমি আর বাইরে যাবোনা। (এটিকে অভ্যাস স্ট্যাকিং বলা হয় এবং এটি অবিশ্বাস্যভাবে কার্যকর)।
২। রুটিন (Routine)
রুটিন হলো একটি অভ্যাসের ভিত্তি। অভ্যাসের সংজ্ঞানুযায়ী আমরা জেনেছি যে, এটি একটি আচরণগত কর্মের পুনরাবৃত্তি। আপনি যদি সচেতনভাবে একটি অভ্যাস তৈরি করতে চান, তাহলে আপনার আচরণগত ক্রিয়াগুলো রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত সম্পাদন করলে কিছুদিন পরে ঐ আচরণগত ক্রিয়াগুলো অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। রুটিন এখানে অভ্যাস বা বারবার করা আচরণ বোঝায়। এটি এমন কিছু হতে পারে যা সম্পর্কে মানুষ সম্পূর্ণরূপে সচেতন, যেমন কাজের কম্পিউটার বন্ধ করা এবং ঘড়ির কাঁটা যখন ৫ টা বেজে যায় তখন ডেস্ক থেকে উঠে পড়া। আরো কিছু অভ্যাস, যেমন একটি কঠিন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার সময় কলমের ডগা চিবানো, এটি কম সচেতনভাবে ঘটতে পারে। তবে অভ্যাসগত আচরণগুলো প্রায়শই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে, যদিও মানুষ প্রথম কয়েকবার সেই পদক্ষেপটি অনুসরণ করার জন্য সচেতনভাবেই করে। উদাহরণ হিসেবে- "আমি ক্লান্ত, তাই আমি এক কাপ কফি খাবো।" বা "আমি বিরক্ত, তাই আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাবো" ইত্যাদি।
৩। পুরষ্কার (Reward)
রুটিন অনুযায়ী আচরণগত ক্রিয়াগুলো সম্পাদন করার পরে, একটি ফলাফল অবশ্যই হবে। আশা করা যায় এই ফলাফলে ঐ ক্রিয়াগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। এই ফলাফলে পুরষ্কারের ব্যাপারটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যখন অভ্যাসের কথা আসে, পুরষ্কারগুলো বোঝায় যে আচরণটি কোন কল্যাণ বয়ে আনে কিনা। পুরষ্কারগুলো রুটিনকে শক্তিশালী করে এবং অভ্যাসকে দৃঢ়ভাবে রাখতে সাহায্য করে। কিছু পুরস্কার সরাসরি উপকার করতে পারে, যেমন- প্রাতঃরাশের পরে দাঁত ব্রাশ করা, একটি পরিষ্কার তাজা মুখ এবং আর স্বাস্থ্যকর নিঃশ্বাসের সাথে পুরস্কৃত করে। সঙ্গীকে মেসেজ করার অভ্যাস আরও ভাল সম্পর্কের পুরস্কার দেয়। কম উপকারী পুরষ্কারগুলো এমন অভ্যাসগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে। যেমন- পুরো সন্ধ্যা YouTube-এ ভিডিও দেখে কাটানো। মস্তিষ্ক এই নির্দিষ্ট আচরণকে পুরষ্কারের সাথে যুক্ত করতে শুরু করলে (এই ক্ষেত্রে, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি), এই আচরণের জন্য একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবেন। পরের বার যখন সন্ধ্যায় বিরক্ত বোধ করলে, নিজের অজান্তেই YouTube-এ নিজেকে খুঁজে পেলে বুঝা যাবে একটি অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে আর এভাবেই একটি অভ্যাস গড়ে উঠে। এই নিয়মিত ক্রিয়াগুলো সকালে দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাসের মতোই সহজ হতে পারে। একটি অভ্যাস গঠনের উপরোক্ত তিনটি দিক ব্যবহার করে যেমন একটি অভ্যাস তৈরি করা যায় এবং একই পদ্ধতিতে অভ্যাস পরিবর্তনও করা যায়।
অভ্যাস পরিবর্তন করার উপায়
অভ্যাস লুপ থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি কিভাবে একটি অভ্যাস গঠিত হয় এবং একটি অভ্যাসকে পরিবর্তন করা যায়। এবার শিখার চেষ্টা করি, অভ্যাসের তৈরির মাধ্যমে জীবন কীভাবে পরিবর্তন করা যায়? জীবন পরিবর্তন করা একটি গভীর ও ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া, যা সময়, প্রচেষ্টা, এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। জীবন পরিবর্তন একটি কঠিন কাজ হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। ছোট ছোট পরিবর্তন থেকে শুরু করে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া পর্যন্ত, জীবনকে নতুন করে গড়ার অনেক উপায় আছে। মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করে ভালো অভ্যাস গড়ার মাধ্যমে জীবন পরিবর্তন করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে অভ্যাস পরিবর্তনে কিছু কমন নিয়ম উল্লেখ করা হলো- অভ্যাসগত কাজে মাঝে মাঝে ব্রেক দেওয়ার অভ্যাস করা। অভ্যাসের বিপরীতে নতুন অভ্যাস তৈরী করতে পুরোনো অভ্যাসগত কাজে ব্রেক দেয়ার অভ্যাস করা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া পুরোনো অভ্যাসের পরিবর্তে নতুন অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে, এমন কল্পনা করে অবচেতন মনে একটি ইতিবাচক ইনপুট দিলে যেকোন অভ্যাস অল্প সময়েই গঠিত বা পরিবর্তিত হতে পারে। সবচেয়ে জরুরী হলো মনের জোর থাকা এবং মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শুধু অভ্যাস নয় জীবনটাকেই পাল্টে দেয়া যাবে নিজের ইচ্ছামতন।
ভালো অভ্যাস গড়ার উপায়
ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা মানে নিজেকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। এটি শুধু একটি পরিবর্তন নয়, এটি একটি যাত্রা। এই যাত্রায় সফল হতে হলে কিছু কৌশল জানা জরুরি। এখানে কিছু উপায় তুলে ধরা হলোঃ
- স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুনঃ কী ভালো অভ্যাস গড়তে চান এবং কেন তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করুন। লক্ষ্যটি স্পষ্ট থাকলে তা অর্জন করা সহজ হয়।
- ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুনঃ একসাথে অনেক অভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা না করে ছোট একটি অভ্যাস গড়ার চেষ্টা করুন। ধীরে ধীরে এটি বড় অভ্যাসে পরিণত হবে। লক্ষ্য বড় হলে লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন। প্রতিটি ছোট জয় আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে।
- নিয়মিত অনুশীলনঃ একটি অভ্যাস গড়ার জন্য নিয়মিত অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন একই সময়ে অভ্যাসটি অনুশীলন করুন। এটি আপনার মস্তিষ্ককে একটি নতুন রুটিন তৈরি করে অভ্যাসে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
- ট্রিগার বা রিমাইন্ডার ব্যবহার করুনঃ আপনার ভালো অভ্যাস গঠনের জন্য একটি ট্রিগার বা রিমাইন্ডার ব্যবহার করুন। উদাহরণস্বরূপ, ঘুম থেকে ওঠার পরপরই জল পান করার অভ্যাস গড়তে চাইলে, বেডসাইডে একটি জল বোতল রাখুন।
- ধৈর্য ধরে থাকুনঃ অভ্যাস গড়তে সময় লাগে। ধৈর্য ধরে অভ্যাসটি অনুশীলন করুন। একদিনেই সব কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না। ধীরে ধীরে শুরু করে ধীরে ধীরে আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করুন। যদি কোনো দিন আপনি আপনার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যান, নিজেকে ক্ষমা করুন এবং আবার শুরু করুন। কখনোই হাল ছাড়বেন না। ভালো অভ্যাস গড়ার জন্য সময় দিন এবং নিজেকে চাপমুক্ত রাখুন।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করুনঃ আপনার সফলতা এবং উন্নতি লক্ষ্য করুন এবং নিজেকে উৎসাহিত করুন। ছোট ছোট অর্জনগুলোকে উদযাপন করুন, যা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।
- পরিবেশ তৈরি করুনঃ আপনার চারপাশের পরিবেশকে এমনভাবে সাজান যাতে এটি নতুন অভ্যাস গড়তে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, পড়ার অভ্যাস গড়তে চাইলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বই রেখে দিন। যদি আপনি সকালে জিমে যাওয়ার অভ্যাস গড়তে চান, তাহলে রাতে আপনার জিমের পোশাক তৈরি করে রাখুন এবং জিম ব্যাগটি দরজার পাশে রাখুন।
- সামাজিক সমর্থন নিনঃ আপনার পরিবার বা বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন নিন। তাদের সঙ্গে আপনার লক্ষ্যের কথা শেয়ার করুন, যাতে তারা আপনাকে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও উৎসাহ দিতে পারে। তাদের সমর্থন আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে।
- পুরস্কার দিনঃ নিজেকে নতুন অভ্যাস গড়তে প্রতিটি ছোট জয়ের জন্য নিজেকে পুরস্কৃত করুন। এটি আপনার মোটিভেশন বাড়াতে সাহায্য করবে। যেমন, এক সপ্তাহ নিয়মিত ব্যায়াম করলে নিজেকে একটি উপহার দিন।
- নেতিবাচক অভ্যাস এড়িয়ে চলুনঃ ভালো অভ্যাস গড়তে চাইলে নেতিবাচক অভ্যাস এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। আপনার অভ্যাস গঠনের পথে যেসব বাধা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে দূরে সরিয়ে রাখুন। নিজেকে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করুন। পজিটিভ মনোভাব আপনাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমাতে চান, তাহলে আপনার ফোন থেকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলি ডিলিট করে দিন।
মন্দ অভ্যাস কাটিয়ে উঠার উপায়
মন্দ অভ্যাস ছাড়া জীবন সত্যিই সুন্দর। কিন্তু অনেক সময়ই আমরা বিভিন্ন কারণে মন্দ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ি। তবে এই অভ্যাসগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মন্দ অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে ধৈর্য, স্থিরতা, এবং সঠিক কৌশল প্রয়োজন। এখানে কিছু উপায় যা মন্দ অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারেঃ
- মন্দ অভ্যাস চিহ্নিত করুনঃ প্রথমে, আপনার মন্দ অভ্যাসটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করুন। কী কারণে এই অভ্যাসটি তৈরি হয়েছে এবং এটি কোন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয়, তা বোঝার চেষ্টা করুন।
- কারণ খুঁজে বের করুনঃ মন্দ অভ্যাসের মূল কারণ খুঁজে বের করুন। এটি মানসিক চাপ, একাকীত্ব, বা কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশ হতে পারে। কারণটি চিহ্নিত করলে সেটি থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে।
- ইতিবাচক বিকল্প তৈরি করুনঃ মন্দ অভ্যাসের পরিবর্তে একটি ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন। উদাহরণস্বরূপ, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের অভ্যাস থাকলে, সেই সময়টায় বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- ধীরে ধীরে পরিবর্তনঃ অভ্যাস পরিবর্তনে ধৈর্য ধরুন এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনুন। আচমকা পুরোপুরি পরিবর্তনের চেষ্টা না করে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন। বড় লক্ষ্যকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন।
- ট্রিগারগুলো এড়িয়ে চলুনঃ আপনার মন্দ অভ্যাসের ট্রিগারগুলি চিহ্নিত করুন এবং সেগুলি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। কোন মন্দ অভ্যাস থেকে পরিত্রাণ পেতে চেইলে প্রথমেই ঐ অভ্যাসের ট্রিগার অংশকে লক্ষ্য করা আবশ্যিক। এই ক্ষেত্রে, অভ্যাসকে ট্রিগার করতে পারে এমন পরিবেশ বা পরিস্থিতিকে এড়াতে পারলে ধীরে ধরে রুটিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং পরবর্তিতে ঐ অভ্যাসের পরিবর্তন হবে। আপনার অভ্যাস পরিবর্তনে ট্রিগার পরিবর্তনের মাধ্যমে অভ্যাসটা অনভ্যাসে পরিণত করা যাবে তাই অভ্যাসের ট্রিগার বুঝতে পারা জরুরী।
- পরিবেশ পরিবর্তন করুনঃ আপনার চারপাশের পরিবেশকে এমনভাবে গড়ে তুলুন যাতে আপনার মন্দ অভ্যাসকে উৎসাহিত না করে।
- সামাজিক সমর্থন নিনঃ পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনদের কাছ থেকে সমর্থন নিন। তাদের সাথে আপনার অভ্যাস পরিবর্তনের পরিকল্পনা শেয়ার করুন, যাতে তারা আপনাকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।
- রেকর্ড রাখাঃ আপনার অগ্রগতি রেকর্ড করুন। প্রতিদিনের অগ্রগতি রেকর্ড করে রাখলে আপনি কতটা সফল হচ্ছেন তা বুঝতে পারবেন এবং এটি আপনাকে আরও উৎসাহিত করবে।
- ধৈর্য ও সংযমঃ মন্দ অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে ধৈর্য এবং সংযম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যাস পরিবর্তন করতে সময় লাগে।, তাই হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যান। যদি কোনো দিন আপনি আপনার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যান, নিজেকে ক্ষমা করুন এবং আবার শুরু করুন।
- নিজেকে পুরস্কৃত করুনঃ যখন আপনি মন্দ অভ্যাস থেকে মুক্তি পান বা উন্নতি করেন, তখন নিজেকে পুরস্কৃত করুন। এটি আপনাকে মোটিভেটেড রাখবে এবং নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
- পেশাদার সাহায্য নিনঃ কিছু মন্দ অভ্যাস, যেমন নেশা বা অবসেশন, কাটিয়ে উঠতে পেশাদার সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মনোবিদ বা কাউন্সেলরের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
একটি নতুন অভ্যাস গঠন করতে কতক্ষণ লাগে?
২১ দিনের নিয়ম
২১ দিন মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে, মানসিক চিকিৎসা ও এক্সপেরিমেন্ট, মাদকাসক্তির নিরাময়, কোন রোগের সিনড্রোম ইত্যাদিতে ২১ দিনের ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত। ডঃ ম্যাক্স মালটজের ১৯৬০ সালে, মাল্টজ সাইকো-সাইবারনেটিক্স (অডিওবুক) নামে একটি বইতে সেই উদ্ধৃতি এবং আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে তার অন্যান্য চিন্তা প্রকাশ করেন। বইটি একটি ব্লকবাস্টার হিট হয়ে ওঠে, ৩০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়। ‘সাইকো-সাইবারনেটিক্স’ গবেষণা অনুসারে যেকোন অভ্যাস তৈরী বা বাদ দিতে কমপক্ষে ২১ দিন সময় লাগে। সমস্যা শুরু হয় তখনই যখন এই ২১ দিন নিয়ে সমাজে মিথ ছড়াতে শুরু করে যে একটি নতুন অভ্যাস তৈরি করতে ২১ দিন সময় লাগে। এই মিথটি সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে কারন এটাকে বিখ্যাত লোকেরা ও বেশি সংখ্যক লোকেরা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছিলো। তাছাড়া মাত্র ৩ সপ্তাহে জীবন পরিবর্তন করার ধারণা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হল ম্যাক্সওয়েল মাল্টজ তার চারপাশে যা ঘটছে তা কেবল পর্যবেক্ষণ করছিলেন কোনরকম সত্যের বা পরীক্ষামূলক বিবৃতি দিচ্ছিলেন না। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে এটি একটি নতুন পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সর্বনিম্ন সময়ের প্রয়োজন। লোকেরা খেয়ালই করেননি যে ডঃ ম্যাক্স মালটজ বলেছিলেন যে "সর্বনিম্ন ২১ দিন", তার মানে হলো একটি অভ্যাস তৈরি হতে সর্বনিম্ন বা কমপক্ষে ২১ দিন সময় লাগে। এই বাক্যটিকেই ভুল করে মানুষ নতুন রূপ দেয়, "একটি নতুন অভ্যাস তৈরি করতে ২১ দিন সময় লাগে।"
তাহলে আসল উত্তর কি? একটি নতুন অভ্যাস তৈরি করতে সত্যিই কতক্ষণ লাগে? একটি খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে কতক্ষণ লাগে? এর সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা কি তা জানার চেষ্টা করি- ফিলিপা লালি লন্ডনের একজন স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞান গবেষক। ইউরোপীয় জার্নাল অফ সোশ্যাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায়, ল্যালি এবং তার গবেষণা দল একটি অভ্যাস তৈরি করতে আসলে কতক্ষণ লাগে তা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গবেষণাটি ১২ সপ্তাহের সময়কালে ৯৬ জনের অভ্যাস পরীক্ষা করে। প্রতিটি ব্যক্তি ১২ সপ্তাহের মধ্যে একটি নতুন অভ্যাস বেছে নিয়েছে এবং তারা অভ্যাসগত আচরণ করেছে কিনা এবং আচরণটি কতটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুভূত হয়েছে সে সম্পর্কে প্রতিদিন রিপোর্ট করেছে। কিছু লোক "দুপুরের খাবারের সাথে এক বোতল জল পান করা" এর মতো সহজ অভ্যাস বেছে নেয়। অন্যরা "রাতের খাবারের আগে ১৫ মিনিট দৌড়ানো" এর মতো আরও কঠিন কাজ বেছে নিয়েছে। ১২ সপ্তাহের শেষে, গবেষকরা একটি নতুন আচরণ শুরু করা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি করতে প্রতিটি ব্যক্তির কত সময় লেগেছে তা নির্ধারণ করতে ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন।
এই বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটি নতুন আচরণ স্বয়ংক্রিয় হয়ে অভ্যাসে পরিণত হতে গড়ে কমপক্ষে ২ মাসেরও বেশি সময় লাগে। আরো স্পেসিফিকভাবে বললে কমপক্ষে ৬৬ দিন সময় লাগে এবং একটি নতুন অভ্যাস গঠন করতে কতক্ষণ সময় লাগে তা ব্যক্তি, আচরণ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। গবেষকরা সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তে উনীত হয়েছেন যে, মানুষ তার প্রত্যাশাগুলি যথাযথভাবে সেট করতে চায় তবে সত্যটি হল মানুষ জীবনে একটি নতুন আচরণ তৈরি করতে সম্ভবত ১৮ দিন থেকে ২৫৪ দিন সময় লাগবে, কোনমতেই স্পেসিফিক ২১ দিন নয়। গবেষকরা আরও দেখেছেন যে "আচরণ সম্পাদন করার একটি সুযোগ হারিয়ে ফেলা অভ্যাস গঠনের প্রক্রিয়াকে বস্তুগতভাবে প্রভাবিত করেনি।" অন্য কথায়, কেউ যদি মাঝে মাঝে গন্ডগোলও করেন তাতে কিছু যায় আসে না। তাই কয়েক সপ্তাহ চেষ্টার পর বা ২১ দিন করার পরেও যদি কাজটি অভ্যাসে পরিণত না হয় তবে মনক্ষুন্ন হবার কোন কারণ নেই। হয়তো এটি অভ্যাসে পরিণত হতে আরো বেশি সময় লাগবে। এক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। "আমি শুধু কাজটি করব এবং এটি খুব শীগ্রই অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে” এই বিশ্বাস মনে ধারন করতে হবে। নিজেকে অবজারবেশনের মধ্যে রাখা জরুরী। ইচ্ছাশক্তি, মনের জোর, সঠিক ট্রিগার প্রয়োগ এবং রুটিন অনুযায়ী কাজ করলে হতেও পারে ১৮ দিন বা ২১ দিনের মধ্যেই কাজটি অভ্যাসে পরিণত হবে।
উপসংহার
অভ্যাস আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন, রুটিন এবং আচরণ হলো সফলতার চাবিকাঠি। আমরা জেনে এসেছি যে “মানুষ অভ্যাসের দাস” কিন্তু আমরা চেষ্টা করলে অভ্যাস লুপ প্রয়োগ করে অভ্যাসকেই মানুষের দাস বানাতে পারি। আমাদের দৈনন্দিন ক্রিয়াগুলোর ক্রমাগত পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে অভ্যাস গঠিত হয়। অভ্যাস আমাদের উৎপাদনশীলতা, স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন, আমরা কীভাবে জীবনে নেভিগেট করি, আমাদের সফলতা, আত্মোন্নতি, লক্ষ্য অর্জন, স্বপ্নপূরণ, সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত বৃদ্ধিতে অভ্যাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অভ্যাসের শক্তি বোঝা অতি জরুরী কারন এটি উপকারী কিনা বা ক্ষতিকারক কিনা সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে। এর থেকে সক্রিয়ভাবে ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলো ভাঙতে সাহায্য করে। একটি স্বাস্থ্যকর রুটিন স্থাপন করে, অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং স্ব-শৃঙ্খলা অনুশীলন করে, আমরা আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে অভ্যাসের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি।
অভ্যাস স্থির নয়, তাই সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনে ক্ষতিকর অভ্যাস পরিবর্তন করে নতুন অভ্যাস গঠন করা যেতে পারে। আমরা আমাদের মূল্যবোধ এবং আকাঙ্ক্ষার সাথে আরও ভালভাবে জড়িত হওয়ার জন্য আমাদের জীবনের অভ্যাসগুলোকে ক্রমাগত পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারি। অভ্যাসগুলো আমাদের চরিত্র এবং জীবনধারার বিল্ডিং ব্লক হিসাবে কাজ করে। আমাদের লক্ষ্য এবং মঙ্গলজনক কাজকে সমর্থন করে এমন অভ্যাস গড়া এবং মানসিক স্বাস্থ্য ও শারিরীক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ করার মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে আরও পরিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ সফল জীবনধারা পরিচালনা করতে পারি। মনে রাখতে হবে, সফল ব্যক্তিদের অভ্যাসই তাদেরকে সফল বানিয়েছে। অনেকেই সফলতার চাবিকাঠি কি? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বেড়ান, এর উত্তরে বলা যেতে পারে- কিছু ভালো অভ্যাসই হরো সফলতার চাবিকাঠি। তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই ১০টি ভালো অভ্যাস শুরু করা যাক।
সচরাচর-জিজ্ঞাস্য
১। প্রশ্নঃ অভ্যাস, আসক্তি ও নেশা কি এক?
উত্তরঃ অনেকেই অভ্যাস, আসক্তি ও নেশাকে এক মনে করেন। এটা সঠিক নয় এই তিনটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। কোন কাজ বা দৈনন্দিন কাজ ধারাবহিকভাবে করতে করতে সেই কাজ অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং, অভ্যাস হলো একটি আচরণগত প্যাটার্ন যা আমরা নিয়মিত বিরতিতে প্রায়শই পুনরাবৃত্তি করি। আবার কোন কাজের অভ্যাস মনে ভালোলাগা সৃষ্টি করলে সেই কাজের ধারাবাহিক অভ্যাসের কারনে আসক্তিতে পরিণত হয়। সুতরাং আসক্তি হলো মনের ক্রিয়াশীল একটা অবস্থা। আর নেশা হলো নির্দিষ্ট বিরতিতে বা ধারাবাহিকভাবে বিশেষ কোন পদার্থ গ্রহন করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে সুখ খোঁজার চেষ্টা করা। নেশা ধারাবাহিক অভ্যাসে ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হয়।
২। প্রশ্নঃ বদ অভ্যাস কী?
উত্তরঃ সে সব অভ্যাস শরীর, মন, পরিবারে বা সমাজের জন্য অকল্যানকর তাকেই বদ অভ্যাস বলে। যেমন- ধুমপান করা, বেশি রাত জাগা, অতিভোজন, মোবাইলের পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা, পরিবারের সদস্যদের সময় না দেওয়া ইত্যাদি হল বদ অভ্যাসের উদাহরণ।
৩। প্রশ্নঃ বদ অভ্যাসের কারণ কি?
উত্তরঃ বদ অভ্যাস বা খারাপ অভ্যাস গড়ে তোলার প্রধান কারণ হল আত্ম-সচেতনতা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব। লোকেরা প্রায়ই কঠিন আবেগ, চাপ বা একঘেয়েমি মোকাবেলা করার জন্য খারাপ অভ্যাস তৈরি করে।
৪। প্রশ্নঃ অভ্যাস কিভাবে জীবনকে প্রভাবিত করে?
উত্তরঃ আমাদের শারীরিক অভ্যাসগুলো আমরা যেভাবে অনুভব করি, আমরা কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করি এবং আমাদের চারপাশের বিশ্বে পরিবেশগত সংকেতের প্রতি যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাই তা গঠন করে। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, স্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়া এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহলের মতো পদার্থ ব্যবহার করার মতো মন্দ অভ্যাসগুলো ক্ষতিকারক শারীরিক প্রভাব তৈরি করতে পারে। আবার ভালো অভ্যাস গঠনের মাধ্যমে নিজেকে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
৫। প্রশ্নঃ বদ অভ্যাস কি জিনগত?
উত্তরঃ জেনেটিক প্রবণতার কারণে আসক্তি ৫০ শতাংশ। বিভিন্ন অভ্যাস/আসক্তির প্রবণতাকে প্রভাবিত করে এমন জিনগত রূপগুলো সাধারণত জিনগুলোতে উপস্থিত থাকে যা মস্তিষ্কের আনন্দ এবং পুরষ্কার প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার অংশ।
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments