Feriwala - Inspiring Heart and Lives

Header Ads Widget

হেডোনিক ট্রেডমিল: কেন সুখের অনুভূতি কখনও স্থায়ী হয় না?

হেডোনিক ট্রেডমিল

হেডোনিক ট্রেডমিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ধারণা যা আমাদের সুখের অনুভূতির অস্থায়িত্বের বিষয়টি তুলে ধরে। অনেক সময়, আমরা নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সুখের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি, তবে আমরা যে স্থায়ী সুখের প্রত্যাশা করি তা কখনোই পূর্ণ হয় না। এই পরিস্থিতিতে, অসুখী মানুষ এবং সামাজিক তুলনা আমাদের আত্মসুখ ও আবেগের অনুভূতিকে হ্রাস করে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে সুখ এবং সম্পর্ক এই দুইয়ের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে; আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকাংশেই নির্ভর করে এই সম্পর্কের গুণমানের উপর। সুখের অনুভূতি কেন স্থায়ী হয় না, তা বোঝার জন্য আমরা অভ্যস্ততা ও সুখের সাইকেলকে বিশ্লেষণ করতে পারি, যা সুখের মাত্রা ও স্থায়িত্বের উপর প্রভাব ফেলে। স্থায়ী সুখ পাওয়ার উপায়গুলোর মধ্যে ধ্যান, ব্যায়াম, এবং নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুখের গবেষণা এবং সুখের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে এই বিষয়গুলোতে আলোকপাত করতে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে আমরা সুখী জীবনযাপন ও সুখী পরিবার গঠনের পথে অগ্রসর হতে পারি। এই নিবন্ধে আমরা হেডোনিক ট্রেডমিলের কারণ এবং এর প্রভাব, সুখের উৎস এবং সুখী সমাজ গঠনের কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করব, যা আমাদের জীবনের মান বৃদ্ধিতে, হৃদয়ের শান্তি অর্জনে এবং সুখের অর্থ বুঝতে সহায়ক হতে পারে।

এই নিবন্ধটি সুখ সিরিজের চতুর্থ পর্ব। সুখ সিরিজের প্রথম পর্বের লিংক এখানে

হেডোনিক ট্রেডমিল
হেডোনিক ট্রেডমিল । Image by Freepik


মানুষের সুখ এবং তার পরিবর্তনশীলতা নিয়ে বহু যুগ ধরেই গবেষণা এবং আলোচনা চলছে। আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে—অর্থনৈতিক উন্নতি, ব্যক্তিগত অর্জন, সম্পর্কের উন্নতি বা ভাঙন, যা মনে হয় আমাদের সুখকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু কিছু সময় পরেই আমরা যেন আগের মতোই জীবনকে অনুভব করতে শুরু করি, নতুন অর্জন বা ক্ষতি আমাদের সুখের স্থায়ী পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য যে তত্ত্বটি মনোবিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছেন, সেটাই হলো হেডোনিক ট্রেডমিল বা Hedonic Treadmill। এটি ব্যাখ্যা করে কিভাবে মানুষ সুখ এবং জীবনসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে, এমনকি তারা বড় ধরনের অর্জন বা বিপর্যয় অভিজ্ঞতা লাভ করার পরেও। মনোবিজ্ঞান মতে, হেডোনিক ট্রেডমিল হলো এমন একটি মানসিক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা বা অর্জনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে সুখী হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুখের অনুভূতি ম্লান হয়ে যায় এবং ব্যক্তি আগের স্বাভাবিক সুখের স্তরে ফিরে আসে। এই ধারণা অনুযায়ী, মানুষ বাহ্যিক পরিবর্তন যেমন আর্থিক উন্নতি, নতুন অর্জন, বা বস্তুগত সম্পদ লাভের মাধ্যমে স্থায়ী সুখ অর্জন করতে চাইলেও, মস্তিষ্ক এসব পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয়, ফলে সুখের মাত্রা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এর মানে, নতুনত্ব এবং অর্জন আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সুখে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না, কারণ আমরা এক পর্যায়ে সেগুলোর প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাই। এটি বোঝায় যে সুখের প্রকৃতি অস্থায়ী এবং বাহ্যিক পরিস্থিতি বা সম্পদ থেকে দীর্ঘস্থায়ী সুখ পাওয়া কঠিন, কারণ প্রত্যাশা এবং অভ্যাস সবসময় পরিবর্তনশীল থাকে।


হেডোনিক ট্রেডমিল (Hedonic Treadmill) ধারণার জনক কে?

হেডোনিক ট্রেডমিল ধারণাটি প্রথমবারে মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ ব্রিকম্যান এবং ডোনাল্ড টি. ক্যাম্পবেল ১৯৭১ সালে তুলে ধরেন। এটি মানুষের অভ্যাস এবং সুখের স্তর কীভাবে কাজ করে তা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ট্রেডমিলের মতো, আপনি যতই দ্রুত বা ধীরে হাঁটেন না কেন, আপনি একই জায়গায় থেকে যান—একইভাবে জীবনে সুখের স্তরও কিছু সময় পর পুনরায় একই অবস্থানে ফিরে আসে, তা যতই আপনি নতুন কিছু অর্জন করেন বা জীবনে পরিবর্তন আনেন। এটি বলছে যে, সুখের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্তর রয়েছে যা আমাদের জীবনে বড় পরিবর্তনগুলোর পরেও দীর্ঘমেয়াদে স্থির থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি নতুন গাড়ি কিনেন বা একটি প্রমোশন পান, শুরুতে এটি আপনাকে খুবই আনন্দ দেয়, কিন্তু কিছুদিন পর এই নতুনত্বের উত্তেজনা কমে যায় এবং আপনি আবার সেই পুরোনো সুখের স্তরে ফিরে যান। একইভাবে, দুঃখজনক ঘটনা (যেমন, চাকরি হারানো বা সম্পর্কের ভাঙন) প্রাথমিকভাবে আপনার সুখের স্তরকে কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু কিছু সময় পর আপনার মানসিক অবস্থা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।


হেডোনিক ট্রেডমিলের মূল ভিত্তি

হেডোনিক ট্রেডমিলের ধারণা মূলত সুখ এবং সন্তুষ্টির অনুভূতির পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে সুখের অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির স্থায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো যে, মানুষের সুখের অনুভূতি একটি নির্দিষ্ট স্তরে স্থিতিশীল থাকে, এবং নতুন অভিজ্ঞতা বা অর্জনের মাধ্যমে সেই স্তর বাড়লেও, কিছু সময় পর তা আবার পূর্বের স্তরে ফিরে আসে। নিম্নে হেডোনিক ট্রেডমিলের মূল ভিত্তিগুলি আলোচনা করা হলো:

  • সুখের স্তরের স্থিতিশীলতা: হেডোনিক ট্রেডমিলের একটি কেন্দ্রীয় দিক হলো সুখের স্তরের স্থিতিশীলতা। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষ যখন নতুন কিছু অর্জন করে—যেমন একটি নতুন চাকরি, গাড়ি, বা বাড়ি—তখন তাদের সুখের অনুভূতি বাড়ে। কিন্তু কিছু সময় পর, সেই সুখের অনুভূতি কমে যায় এবং তারা আবার পূর্বের সুখের স্তরে ফিরে আসে। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রবণতা যা মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে।
  • অভ্যস্ততা (Habituation): মানুষের সুখের অনুভূতি পরিবর্তন হতে থাকে কারণ তারা নতুন অভিজ্ঞতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন গাড়ি কেনা শুরুর দিকে খুব আনন্দদায়ক হতে পারে, কিন্তু কিছু মাস পরে, সেই গাড়ির প্রতি আগ্রহ কমে যায়। এই প্রক্রিয়াটি অভ্যস্ততা নামক একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ ঘটে, যেখানে নতুন অভিজ্ঞতাগুলি সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক বা সাধারণ মনে হয়।
  • সামাজিক তুলনা: মানুষের সুখের অনুভূতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক তুলনা। আমরা যখন আমাদের জীবন এবং সুখের অনুভূতি অন্যদের সঙ্গে তুলনা করি, তখন তা আমাদের আত্মসচেতনতা ও সন্তুষ্টির অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। যদি আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের বন্ধু বা সহকর্মীরা সুখী বা সফল, তবে আমাদের নিজেদের সুখের অনুভূতি হ্রাস পেতে পারে। এই সামাজিক তুলনার ফলে আমাদের সুখের অনুভূতি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ে।
  • উদ্দীপনা: মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা বা অর্জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণ তাদের সুখের অনুভূতিকে উজ্জীবিত করে। কিন্তু, যেহেতু নতুন উদ্দীপনা সাধারণত অস্থায়ী হয়, তাই এর স্থায়িত্ব কমে যায় এবং আমাদের সুখের স্তর আবার হ্রাস পায়। এটি হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অংশ।
  • জীবনের বিভিন্ন দিক: হেডোনিক ট্রেডমিল আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিক—যেমন সম্পর্ক, কর্মজীবন, এবং স্বাস্থ্য—প্রভাবিত করে। মানুষ প্রায়ই সুখের নতুন উৎস খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু একে অপরের সাথে তুলনা করে তাদের আনন্দের অনুভূতি কমে যেতে পারে।


হেডোনিক ট্রেডমিলের উপাদানসমূহ

হেডোনিক ট্রেডমিলের উপাদানসমূহ মানুষের সুখ ও সন্তুষ্টির অনুভূতির বিভিন্ন দিককে বোঝাতে সাহায্য করে। এই উপাদানগুলো একসাথে কাজ করে এবং আমাদের সুখের অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এখানে হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রধান উপাদানগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

  • অভ্যস্ততা ও সুখ: অভ্যস্ততা হল একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষের সুখের অনুভূতি নতুন অভিজ্ঞতা বা অর্জনের পরে দ্রুত কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ একটি নতুন গাড়ি কিনে তখন প্রথমে তারা খুব আনন্দিত হয়, কিন্তু কিছু সময় পর, সেই আনন্দের অনুভূতি কমে যায় এবং তারা আবার নতুন গাড়ির জন্য আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে। এটি আমাদের বোঝায় যে আমরা সুখের একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছানোর পর তা ধরে রাখতে সক্ষম হই না।
  • সুখের মাত্রা: হেডোনিক ট্রেডমিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সুখের মাত্রা। মানুষের সুখের অনুভূতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। আমরা বিভিন্ন ঘটনাগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন মাত্রার সুখ অনুভব করি। এই সুখের মাত্রা আমাদের অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের আশেপাশের মানুষের অবস্থার উপর নির্ভর করে। যখন আমাদের সুখের মাত্রা বেড়ে যায়, আমরা তৎক্ষণাৎ নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করি এবং নতুন কিছু অর্জনের জন্য চেষ্টা করি।
  • আপেক্ষিকতা: হেডোনিক ট্রেডমিলের আপেক্ষিকতা মানুষের সুখের অনুভূতিতে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের সুখের অনুভূতি প্রায়শই আমাদের সামাজিক পরিবেশ এবং অন্যদের সাথে তুলনার উপর নির্ভর করে। যদি আমাদের বন্ধুদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়, তবে আমাদের নিজেদের সুখের অনুভূতিও কমতে পারে। এই আপেক্ষিকতা আমাদের অনুভূতি এবং সুখের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে।
  • আকর্ষণ: মানুষ সাধারণত সুখের অনুভূতি অর্জনের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক, অথবা সামগ্রীতে আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণটি আমাদেরকে নতুন অভিজ্ঞতা সন্ধান করতে এবং আমাদের সুখের স্তর বাড়াতে উত্সাহিত করে। কিন্তু এটি হেডোনিক ট্রেডমিলের অংশ, যেখানে আমরা একবারে সুখের স্তরে পৌঁছানোর পর তা অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখাই।
  • সামাজিক সম্পর্ক: হেডোনিক ট্রেডমিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সামাজিক সম্পর্ক। মানুষের সামাজিক সমর্থন এবং সম্পর্কগুলি তাদের সুখের অনুভূতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাল সামাজিক সম্পর্ক আমাদের সুখের স্তর বাড়াতে সাহায্য করে, কিন্তু যখন আমরা একে অপরের সঙ্গে তুলনা করি, তখন আমাদের সুখের অনুভূতি কমে যেতে পারে।
  • মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও প্রভাব: মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আমাদের হেডোনিক ট্রেডমিলের অভিজ্ঞতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা মানসিক চাপ বা হতাশায় ভুগছেন, তারা সাধারণত সুখের অনুভূতি কম পান। এর ফলে তারা নতুন কিছু অর্জনের জন্য প্রেরণা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং এই অবস্থা তাদের সুখের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
  • সাংস্কৃতিক প্রভাব: সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও হেডোনিক ট্রেডমিলের উপাদানগুলোর মধ্যে একটি। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সুখের অনুভূতির সংজ্ঞা এবং তারা কীভাবে সুখ অর্জন করে তা ভিন্ন হতে পারে। কিছু সংস্কৃতি ঐক্য এবং সম্পর্কের উপর জোর দেয়, যা সুখের অনুভূতিকে বাড়াতে সাহায্য করে, অন্যদিকে কিছু সংস্কৃতি ব্যক্তিগত অর্জন এবং সফলতার উপর বেশি গুরুত্ব দেয়।


হেডোনিক ট্রেডমিলের বৈশিষ্ট্য

হেডোনিক ট্রেডমিল একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা যা মানুষের সুখ এবং সন্তুষ্টির অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। এটি বোঝায় যে আমরা সুখী হওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যা অর্জন করি তার প্রতি আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ঘটে। এখানে এই ধারণাটির বৈশিষ্ট্যগুলি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

  • অভ্যস্ত হওয়া: হেডোনিক ট্রেডমিলের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মানুষের অভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা। যখন আমরা নতুন কিছু অর্জন করি, যেমন একটি নতুন চাকরি, গাড়ি বা সম্পর্ক, তখন তা আমাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, আমরা ওই সুখের অনুভূতির প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এই অভ্যাসটি আমাদের সুখের অনুভূতিকে কমিয়ে দেয়, যা আমাদের আরও নতুন অভিজ্ঞতা ও সুখ অন্বেষণের দিকে ধাবিত করে।
  • সক্ষমতা বজায় রাখা: এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আমরা সাধারনত একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছানোর পর, আমাদের সুখের স্তর বজায় রাখতে চেষ্টা করি। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ একটি নতুন গাড়ি কেনে এবং তা থেকে আনন্দ পায়, তাহলে কিছু সময় পরে তারা আবার নতুন গাড়ির জন্য আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে। এটি আমাদের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করে যে আমরা সর্বদা নতুন কিছু প্রয়োজন।
  • আপেক্ষিক সুখ: হেডোনিক ট্রেডমিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আপেক্ষিক সুখের ধারণা। আমাদের সুখের অনুভূতি প্রায়শই আমাদের আশেপাশের মানুষের অবস্থার সাথে তুলনা করে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের বন্ধু বা সহকর্মীরা একটি নতুন বাড়ি কিনে, তবে আমরা নিজেদের অবস্থাকে তাদের সাথে তুলনা করতে শুরু করি এবং নিজেদের সুখের অনুভূতি কমে যেতে পারে। এটি আমাদের নতুন কিছু অর্জনের জন্য আরও প্রেরণা দেয়।
  • প্রবণতা: হেডোনিক ট্রেডমিল আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা সৃষ্টি করে, যেখানে আমরা নতুন সুখের সন্ধানে থাকি। একবার যখন আমরা একটি সুখের স্তরে পৌঁছাই, তখন আমরা তা ধরে রাখতে চাই এবং সাধারণত আমাদের আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে শুরু করি। এটি আমাদের অবসাদ এবং অশান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে, কারণ আমরা সর্বদা কিছু নতুন এবং উন্নত কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছি।
  • প্রতিক্রিয়া: হেডোনিক ট্রেডমিলের এই প্রক্রিয়াটি আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং অনুভূতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যখন আমরা নতুন কিছু অর্জন করি এবং তা থেকে আনন্দ পাই, তখন আমরা সেই আনন্দের অনুভূতি বজায় রাখতে চাই। তবে, এই আনন্দের স্তর কমে গেলে, আমরা দ্রুত নতুন লক্ষ্য এবং আকাঙ্ক্ষা সেট করতে শুরু করি। ফলে, আমরা আবার সেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাই, যেখানে আমাদের সুখের অনুভূতি আগের মতো থাকে না।


হেডোনিক ট্রেডমিলের উদাহরণ

  • নতুন গাড়ি: যখন একজন ব্যক্তি একটি নতুন গাড়ি কেনে, প্রথমে তারা খুব আনন্দিত হয় এবং গাড়িটি ব্যবহার করে তাদের সুখের অনুভূতি বেড়ে যায়। কিন্তু কিছু মাস পর, তারা গাড়ির প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং নতুন কিছু খুঁজে বের করার জন্য আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে। এরপর তারা নতুন মডেলের গাড়ির জন্য পরিকল্পনা করে, ফলে পূর্বের সুখের অনুভূতি কমে যায়।
  • নতুন চাকরি: একজন ব্যক্তি যখন নতুন চাকরি পায়, তখন সে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয় এবং মনে করে যে তার জীবন পরিবর্তিত হয়েছে। কিছু সময় পরে, চাকরির কাজের চাপ এবং নতুন পরিবেশের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজের নতুন চ্যালেঞ্জগুলি যখন স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন তার পূর্বের আনন্দের অনুভূতি কমে যায় এবং সে আবার নতুন চাকরির সন্ধানে যেতে পারে।
  • প্রেমের সম্পর্ক: প্রথমে নতুন প্রেমের সম্পর্কের সময় উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ থাকে। কিন্তু কিছু সময় পর, যখন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা এবং ডিনামিক্স অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন সেই সুখের অনুভূতি কমে যায়। এর ফলে, এক বা উভয় পার্টনার নতুন রোমান্স বা উত্তেজনার সন্ধানে যেতে পারে।
  • অফিসে প্রমোশন: কেউ যদি অফিসে প্রমোশন পায়, তবে সে খুব খুশি হয় এবং এটি তার জন্য একটি নতুন উচ্ছ্বাসের উৎস হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুদিন পর, নতুন দায়িত্ব এবং চাপের কারণে সেই আনন্দ কমে যায়। তখন সে হয়তো আরও উচ্চ পদে যাওয়ার জন্য চিন্তা করতে শুরু করে।
  • বাড়ির মালিকানা: যখন কেউ প্রথমবারের মতো বাড়ি কেনে, তখন তারা মনে করে যে এটি তাদের সুখী জীবনযাপনের সূচনা করেছে। তবে কিছু সময় পরে, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যান্য দায়িত্বের কারণে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সুখের অনুভূতি কমে যায়। এর ফলে, তারা নতুন বাড়ি কিনতে বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারে।
  • সামাজিক মিডিয়া: সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নতুন বন্ধু তৈরি করার সময় প্রথমে আনন্দের অনুভূতি থাকে। তবে কিছুদিন পর, মানুষের আগ্রহ কমে যায় এবং তারা নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ কন্টেন্টের সন্ধানে থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বা অ্যাপসে সময় ব্যয় করতে শুরু করে।
  • সন্তানের জন্ম: সন্তানের জন্মের পর অভিভাবকরা প্রথমে অসীম আনন্দ অনুভব করেন। তবে কিছু মাস পরে, সন্তানের যত্ন এবং দায়িত্বের কারণে তাদের সেই আনন্দের অনুভূতি কমে যায় এবং তারা নতুন সুখের উৎসের সন্ধানে থাকতে পারে।


হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব

হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব মানুষের জীবনযাপন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুখের অনুভূতির উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। এই ধারণাটি বোঝায় যে, মানুষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও অর্জনের মাধ্যমে সুখের স্তর বৃদ্ধি করতে চায়, তবে একবার সুখের একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছালে তারা পুনরায় নতুন সুখের সন্ধানে যেতে থাকে। এই প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। এখানে হেডোনিক ট্রেডমিলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

  • সুখের অস্থিরতা: হেডোনিক ট্রেডমিলের একটি মূল প্রভাব হলো সুখের অস্থিরতা। মানুষের সুখের অনুভূতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, এবং তারা যখন নতুন কিছু অর্জন করে তখন প্রথমে আনন্দিত হয়। কিন্তু কিছু সময় পরে, এই আনন্দের অনুভূতি কমে যায় এবং তারা পুনরায় সুখের সন্ধানে থাকে। এর ফলে, মানুষের জীবনে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যেখানে তারা সর্বদা সুখী থাকতে চেষ্টা করলেও তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • সন্তুষ্টির অভাব: যখন মানুষ হেডোনিক ট্রেডমিলের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তাদের সন্তুষ্টির অনুভূতি কমে যায়। একবার তারা একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছালে, তারা পুনরায় নতুন অর্জনের জন্য চেষ্টা শুরু করে। এই অবস্থায়, মানুষ তাদের অর্জনের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছে না এবং তারা সবসময় নতুন কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে, যা তাদের অবসাদ বা হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য: হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক হতে পারে। যখন মানুষ সুখের জন্য প্রচেষ্টা করে এবং তা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন তারা মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার শিকার হতে পারে। এই অবস্থায়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে, এবং তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
  • সম্পর্কের চাপ: হেডোনিক ট্রেডমিলের ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলিতেও চাপ পড়তে পারে। যখন এক বা উভয় পার্টনার সুখের সন্ধানে নতুন কিছু খুঁজতে থাকে, তখন তারা একে অপরের সাথে তুলনা করতে শুরু করে। এই তুলনা সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, যা সম্পর্কের স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
  • সামাজিক তুলনা: মানুষ প্রায়ই নিজেদের সুখের অনুভূতি অন্যদের সাথে তুলনা করে। হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব হিসেবে, যখন তাদের আশেপাশের অন্যদের জীবনযাত্রার মান বাড়ে, তখন তারা নিজেদের জীবনকে কম সুখী মনে করতে পারে। এই সামাজিক তুলনার ফলে উদ্বেগ এবং হতাশা বাড়তে পারে।
  • নতুন অভিজ্ঞতার প্রতি আকর্ষণ: হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাবের কারণে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতার দিকে আকৃষ্ট হয়। একবার যখন তারা একটি সুখের স্তরে পৌঁছায়, তখন তারা নতুন কিছু খুঁজে বের করার জন্য উৎসাহিত হয়। যদিও এটি তাদের জীবনে নতুনত্ব এবং উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে, তবে এটি সেই সুখের অনুভূতিকে আবারও কমিয়ে দেয়।
  • সুখের দীর্ঘস্থায়িত্ব: হেডোনিক ট্রেডমিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল সুখের দীর্ঘস্থায়িত্বের অভাব। যখন মানুষ তাদের সুখের অনুভূতি বাড়ানোর জন্য নতুন কিছু খুঁজতে থাকে, তখন তারা প্রায়ই সেই সুখের স্থায়িত্বে ব্যর্থ হয়। এই প্রক্রিয়া তাদেরকে সুখী হতে না পারার অনুভূতি এবং হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
  • আত্ম মূল্যায়ন: হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব স্ব-মানসিকতার উপরও প্রভাব ফেলে। যখন মানুষ তাদের অর্জনের ভিত্তিতে নিজেদের মূল্যায়ন করে এবং তা সন্তুষ্টির স্তরের সঙ্গে মেলে না, তখন তাদের আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে।


হেডোনিক ট্রেডমিলের কারণ

হেডোনিক ট্রেডমিলের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো গভীরভাবে আমাদের মস্তিষ্কের অভিযোজন ক্ষমতা, অভ্যাস গঠন, এবং তুলনামূলক মনোভাবের সঙ্গে জড়িত। এর মূল ধারণাটি হচ্ছে, মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে নতুন অভিজ্ঞতা এবং অর্জনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, যার ফলে সুখের অনুভূতিও সময়ের সাথে সাথে ম্লান হয়ে যায়। এটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঘটার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।


প্রথমত, আবেগীয় অভিযোজন (Emotional Adaptation) প্রক্রিয়া এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানব মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে নতুন উদ্দীপনা বা ঘটনার প্রতি সংবেদনশীল হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্দীপনার প্রতি আমাদের সংবেদনশীলতা কমতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ কোনো নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যেমন নতুন বাড়ি কেনা বা প্রমোশন পাওয়া, তখন প্রথমে এটি তাকে প্রচণ্ড আনন্দ দেয়। তবে কিছুদিন পর সেই অভিজ্ঞতা তার জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে যায় এবং আনন্দের তীব্রতা কমে যায়। এটি একটি স্বাভাবিক মানসিক প্রক্রিয়া, যেখানে মস্তিষ্ক ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোনো অভিজ্ঞতাকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে, যেন জীবনের স্থায়িত্ব বজায় থাকে। এই প্রক্রিয়া আমাদের মনকে বেশি সংবেদনশীলতা থেকে মুক্ত রাখে, কিন্তু একইসঙ্গে এটি সুখকে অস্থায়ী করে তোলে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক মানসিকতা (Comparative Mindset) আমাদের সুখকে প্রভাবিত করে। আমরা প্রায়ই নিজেদের অন্যদের সঙ্গে তুলনা করি, বিশেষত যাদের জীবনযাত্রা আমাদের থেকে বেশি সমৃদ্ধ মনে হয়। এই সামাজিক তুলনা আমাদের মধ্যে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করে, কারণ আমরা তখন অনুভব করি যে আমাদের যা আছে তা যথেষ্ট নয়। এটি বিশেষ করে তখনই বেশি ঘটে যখন আমরা কোনো নতুন অর্জন করি বা কোনো লক্ষ্য পূরণ করি, যেমন একটি উচ্চ বেতনের চাকরি পাওয়া বা কোনো বিশেষ সাফল্য অর্জন করা। এই অর্জনের পরে আমরা আমাদের আশেপাশের অন্যদের সফলতা ও সম্পদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের তুলনা করতে শুরু করি, যা আমাদের মনের ভেতরে অসম্পূর্ণতার অনুভূতি তৈরি করে। ফলে, আগের যে অর্জনটি আমাদের এত আনন্দ দিয়েছিল, সেটি ধীরে ধীরে আমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হতে শুরু করে। তৃতীয়ত, প্রত্যাশার বৃদ্ধি (Escalating Expectations) হেডোনিক ট্রেডমিলের আরেকটি প্রধান কারণ। মানুষ সবসময় নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় কিছু প্রত্যাশা করে। যখন আমরা নতুন কিছু পাই বা অর্জন করি, তখন আমাদের মনের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা একসময় আমাদের নতুন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। এরপর আমরা আরও নতুন, আরও বড় কিছু অর্জনের জন্য আকাঙ্ক্ষা করি। উদাহরণস্বরূপ, প্রথমবার নতুন গাড়ি কেনার সময় যেই আনন্দ হয়, কয়েক বছরের ব্যবধানে আবার নতুন গাড়ি কেনার সময় সেই আনন্দ আগের মতো থাকে না, কারণ আমাদের প্রত্যাশার মান সেইসঙ্গে বেড়ে যায়।


অন্যদিকে, আচরণগত অভ্যাস (Behavioral Habits) এবং রুটিনের প্রভাবও সুখের ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা নতুন কিছু পেলে তার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেই এবং সেটিকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে ফেলি। নতুন অভ্যাস বা রুটিন দ্রুত আমাদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে যাওয়ার ফলে সেই নতুনত্বের অনুভূতি হারিয়ে যায় এবং আমাদের সুখও পুনরায় আগের স্তরে ফিরে আসে। হেডোনিক ট্রেডমিলের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর মূল কথা হলো, মানুষের মনসিকতা এমনভাবে তৈরি যে আমরা নতুনত্বের আনন্দ বা কষ্ট থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসি, এবং আমাদের মস্তিষ্ক পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। এটি একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তার জন্য কার্যকর, কিন্তু সুখের দিক থেকে এটি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সন্তুষ্টির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে।


হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তির উপায়

হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়া মানে হলো সেই মনস্তাত্ত্বিক দৌড়ের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা, যেখানে আমরা সবসময় নতুন কিছু অর্জন করতে চাই, কিন্তু সেই নতুনত্বের সাথে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যাই, ফলে স্থায়ীভাবে সুখী হতে ব্যর্থ হই। যদিও মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সুখের এই দৌড়ের মধ্যে থাকে, কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। কিছু কৌশলের মাধ্যমে আমরা এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং একটি স্থায়ী, গভীর তৃপ্তিময় জীবন উপভোগ করতে পারি। নিচে হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়ার বিস্তারিত উপায় তুলে ধরা হলো।


কৃতজ্ঞতা চর্চা (Gratitude Practice)

কৃতজ্ঞতা চর্চা হলো এমন একটি কার্যকর পন্থা, যা মানুষকে তার জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর উপর মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক ছোট ছোট উপহার বা আনন্দকে উপেক্ষা করি, কিন্তু কৃতজ্ঞতা চর্চার মাধ্যমে আমরা যা পেয়েছি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখি। এটি হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, কারণ এটি আমাদের মনোযোগকে বাহ্যিক অর্জনের চেয়ে অভ্যন্তরীণ সুখ এবং সাফল্যের উপর কেন্দ্রীভূত করে।


কিভাবে কৃতজ্ঞতা চর্চা করবেন:

  • দিনের শেষে ধন্যবাদ জার্নাল লিখুন: প্রতিদিন রাতে ৩-৫টি বিষয় লিখুন, যেগুলো আপনাকে আনন্দ দিয়েছে বা যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ। এটি হতে পারে একটি সুন্দর সান্ধ্যভ্রমণ, বন্ধুর কাছ থেকে একটি ভালো কথা, বা একটি ভালো খাবার।
  • ক্ষুদ্র আনন্দ উপভোগ করুন: আপনার জীবনধারায় ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যেমন—একটি সুন্দর বই পড়া, সূর্যাস্ত দেখা, বা প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানোর জন্য সচেতনভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
  • কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন: যারা আপনার জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে তাদের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ বা প্রশংসা জানানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি মানসিক শান্তি এবং সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক।


মাইন্ডফুলনেস (Mindfulness) এবং ধ্যান (Meditation)

মাইন্ডফুলনেস এবং ধ্যান হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম কার্যকর উপায়। মাইন্ডফুলনেস হলো বর্তমান মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে মনোযোগ দেওয়া, যা আমাদেরকে অতীতের চিন্তা বা ভবিষ্যতের উদ্বেগ থেকে মুক্ত রাখে। ধ্যান এবং মাইন্ডফুলনেস চর্চা করলে মানুষের মানসিক চাপ কমে, আত্মতৃপ্তি বৃদ্ধি পায় এবং সুখের দীর্ঘস্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে।


মাইন্ডফুলনেস চর্চার উপায়:

  • গভীর শ্বাসের অনুশীলন: সুখের জন্য ধ্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট ধ্যান বা গভীর শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন করুন। এটি আপনাকে বর্তমান মুহূর্তে নিয়ে আসবে, মানসিক চাপ কমাবে এবং আপনাকে সুখী করবে।
  • খাবার খাওয়ার সময় মাইন্ডফুলনেস চর্চা করুন: খাবার খাওয়ার সময় ধীরগতি বজায় রাখুন এবং সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খাবারের প্রতি মনোযোগ দিন। খাবারের সুগন্ধ, স্বাদ এবং টেক্সচার উপভোগ করে দেখুন।
  • চিন্তা এবং আবেগকে পর্যবেক্ষণ করা: যখন আপনি কোনো চিন্তা বা আবেগ অনুভব করেন, সেগুলোকে মূল্যায়ন না করে সেগুলোর উপর নজর দিন। এটি আপনাকে নিজের অনুভূতির উপর সচেতনতা দেবে এবং আবেগের প্রতিক্রিয়া কমাবে।


শারীরিক ব্যায়াম (Physical Exercise)

হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে শারীরিক ব্যায়ামের ভূমিকা অপরিসীম। হেডোনিক ট্রেডমিল হল একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা বা অর্জনের মাধ্যমে সাময়িক সুখ পায়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুখের অনুভূতি কমে যায়। শারীরিক ব্যায়াম এই প্রক্রিায়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।


শারীরিক ব্যায়ামের ভূমিকা:

  • মানসিক চাপ কমানো: সুখের জন্য ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারন ব্যায়াম শারীরিক এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। শারীরিক কার্যকলাপ এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, যা আমাদের মস্তিষ্কে সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং চাপের প্রভাবকে কমায়।
  • সচেতনতা এবং বর্তমান মুহূর্তে থাকা: শারীরিক ব্যায়াম, বিশেষ করে যোগব্যায়াম এবং ধ্যানমুলক হাঁটার মাধ্যমে, আমাদের মনকে বর্তমান মুহূর্তে রাখতে সাহায্য করে। এতে হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব কমে যায়, কারণ আমরা অতীতের চিন্তা বা ভবিষ্যতের উদ্বেগ থেকে দূরে থাকতে পারি।
  • সুস্থতা বৃদ্ধি: নিয়মিত ব্যায়াম আমাদের শারীরিক সুস্থতা বাড়ায়, যা স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাস এবং সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। সুস্থ শরীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে পরিচালিত করে।
  • আবেগ নিয়ন্ত্রণ: শারীরিক ব্যায়াম আমাদের আবেগের প্রতি মনোযোগী হতে এবং তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। এটি আমাদের আবেগের প্রতিক্রিয়া কমাতে এবং সুখের অনুভূতিকে স্থায়ী করতে সহায়ক।
  • দীর্ঘমেয়াদী সুখের অনুভূতি: শারীরিক ব্যায়াম একটি সঠিক রুটিনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেলে, এটি আমাদের সুখের অনুভূতিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে। যখন আমরা নিয়মিত ব্যায়াম করি, তখন আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে, যা আমাদের জীবনে সুখের স্থায়িত্ব বাড়ায়।


অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য স্থাপন (Intrinsic Goal Setting)

হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য স্থাপন করা। বাহ্যিক লক্ষ্য যেমন: অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা বা পদোন্নতি দীর্ঘমেয়াদী তৃপ্তি দিতে ব্যর্থ হয়, কারণ এগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহ দ্রুত কমে যায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য, যেমন: নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বিকাশ, বা মানসিক প্রশান্তি অর্জন দীর্ঘমেয়াদী সুখ এনে দিতে পারে। অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য আমাদের নিজস্ব উন্নয়ন এবং মানসিক সমৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে, যা বাহ্যিক অর্জনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।


অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য কীভাবে স্থাপন করবেন:

  • দক্ষতা এবং শিখন: এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করুন যা আপনাকে নতুন কিছু শিখতে বা দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন ভাষা শেখা বা একটি সৃজনশীল প্রকল্পে কাজ করা।
  • ব্যক্তিগত উন্নতি: আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান এবং মানসিক শান্তি বৃদ্ধি করার জন্য ব্যক্তিগত লক্ষ্য স্থাপন করুন। নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করুন এবং সেগুলো অতিক্রম করার চেষ্টা করুন।
  • সৃজনশীলতা বিকাশ: শিল্পকলা, লেখালেখি, সংগীত, বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকার মাধ্যমে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়ান।


সামাজিক সংযোগ এবং সম্পর্কের মান উন্নয়ন (Social Connection and Improving Relationship Quality)

হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পেতে মানবিক সম্পর্ক এবং সামাজিক সংযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ, পদোন্নতি, বা ভোগবিলাসের চেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সুখে বেশি প্রভাব ফেলে। গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক থেকে যে মানসিক তৃপ্তি আসে, তা অর্থ বা বাহ্যিক অর্জন দিয়ে অর্জন করা যায় না।


সম্পর্কের মান উন্নয়নের উপায়:

  • বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সময় কাটান: নিয়মিতভাবে প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। সম্পর্কগুলোকে গভীর এবং আন্তরিক করতে সচেতনভাবে উদ্যোগী হোন।
  • সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা: সম্পর্কের মধ্যে সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা বৃদ্ধি করুন। অন্যদের প্রতি যত্নবান এবং সহায়ক হলে আপনি নিজের মধ্যে মানসিক তৃপ্তি অনুভব করবেন।
  • সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি করুন: দৈনন্দিন ছোটখাটো কথাবার্তার চেয়ে গভীর আলোচনা করুন। মানসিক স্তরের সংযোগ মানুষকে স্থায়ী সুখ এনে দেয়।


অভিজ্ঞতা অর্জন বনাম বস্তুগত সম্পদ (Experience over Material Possessions)

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বস্তুগত সম্পদ (যেমন: বাড়ি, গাড়ি, বা দামি সামগ্রী) মানুষের সুখকে সাময়িকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা সুখের স্তরকে স্থায়ীভাবে উন্নত করতে পারে না। এর বিপরীতে, অভিজ্ঞতা (যেমন: ভ্রমণ, সৃজনশীল কার্যক্রম, বা প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো) দীর্ঘস্থায়ী সুখের জন্য অনেক বেশি কার্যকর। অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে এবং মূল্যবান স্মৃতি তৈরি করে, যা আমাদের সুখের স্তরকে উচ্চতর রাখে।


অভিজ্ঞতা অর্জনের কৌশল:

  • ভ্রমণ: নতুন জায়গায় ভ্রমণ করুন এবং ভিন্ন সংস্কৃতি, মানুষ এবং পরিবেশের সাথে পরিচিত হন। এটি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করবে এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দেবে।
  • সৃজনশীল কার্যক্রমে যুক্ত হন: শিল্পকর্ম, সংগীত, বা অন্য কোনো সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করুন।
  • সময় এবং অভিজ্ঞতা উপহার দিন: প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে মানসিক সংযোগ বাড়ান। বস্তুগত জিনিসের পরিবর্তে তাদের অভিজ্ঞতা উপহার দিন।


জীবনের ছোটখাটো আনন্দকে উপভোগ করা (Savoring the Little Joys of Life)

হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলোকে উপভোগ করা এবং সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ থাকা। বড় অর্জনের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যেমন: এক কাপ চা, একটি সুন্দর সূর্যাস্ত, বা বন্ধুর সাথে কথোপকথন ইত্যাদি আমাদের মানসিক শান্তি এবং স্থায়ী সুখ এনে দেয়।


ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করার উপায়:

  • মাইন্ডফুলনেস চর্চা: প্রতিদিনের ছোটখাটো মুহূর্তগুলোতে মনোনিবেশ করুন। খাবার খাওয়া, হাঁটাহাঁটি করা, বা সঙ্গীত শোনার সময় পুরোপুরি সেই মুহূর্তে থাকার চেষ্টা করুন।
  • ক্ষুদ্র অর্জন উদযাপন করুন: আপনার প্রতিদিনের ছোটখাটো সাফল্যগুলো উদযাপন করুন, যেমন- একটি লক্ষ্য পূরণ করা বা একটি নতুন দক্ষতা শেখা।
  • নিয়মিত বিরতি নিন: কাজের সময় নিয়মিত বিরতি নিয়ে নিজের মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধার করুন। অল্প সময়ের জন্য নিজেকে প্রকৃতির মাঝে নিয়ে যান বা নিরিবিলি বসে থাকুন।


মাঝে মাঝে শখের কাজগুলো করা (Engaging in Hobbies Occasionally)

মাঝে মাঝে শখের কাজ করা হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি প্রাকৃতিক এবং কার্যকর উপায়। এটি আমাদের বাহ্যিক অর্জনের ওপর নির্ভরশীলতা কমায় এবং অভ্যন্তরীণ তৃপ্তি, মানসিক প্রশান্তি, নতুন দক্ষতা অর্জন, সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি এবং জীবনের প্রকৃত সুখ অর্জনে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে আমরা জীবনের ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করতে পারি এবং বাহ্যিক অর্জনের দৌড় থেকে দূরে থাকতে পারি, যা আমাদের জীবনে স্থায়ী সুখ এবং তৃপ্তি এনে দেয়। শখের কাজ আমাদের মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধার করতে, নতুন অভিজ্ঞতা এবং সম্পর্ক গড়তে, এবং জীবনের ছোট ছোট আনন্দকে উপভোগ করতে সাহায্য করে, যা আমাদের জীবনে স্থায়ী সুখ এনে দেয়। নিচে কিভাবে শখের কাজগুলো হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করা হলো:

  • আন্তরিক আনন্দ (Intrinsic Joy) এবং অভ্যন্তরীণ তৃপ্তি (Intrinsic Satisfaction): শখের কাজগুলো সাধারণত বাহ্যিক লক্ষ্য (যেমন অর্থ, খ্যাতি, বা পদোন্নতি) অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয় না। এগুলো থেকে আমরা আন্তরিক সুখ, আনন্দ এবং অভ্যন্তরীণ তৃপ্তি পাই, যা হেডোনিক ট্রেডমিলের বাহ্যিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। হেডোনিক ট্রেডমিল ধারণায় মানুষ সবসময় নতুন অর্জনের জন্য দৌড়ায়, কিন্তু শখের কাজগুলোতে এমন কোনো অর্জনের চাপ থাকে না। বরং এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ আনন্দ দেয়, যা বাহ্যিক চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী ও গভীর। উদাহরণস্বরূপ, ছবি আঁকা, বই পড়া, সংগীত শোনা, বাগান করা, ছবি তোলা, মাছ ধরা, নৃত্য, লেখালিখি করা, সোস্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট ক্রিয়েটিং ইত্যাদি হলো এমন কিছু কাজ যা কোনো আর্থিক বা সামাজিক পুরস্কারের জন্য নয়, বরং নিজের মানসিক তৃপ্তির জন্য করা হয়,যা আমাদের ব্যক্তিগত সুখের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। ।
  • বর্তমান মুহূর্তে থাকার অভ্যাস (Mindfulness and Flow State): শখের কাজগুলো করার সময় আমরা সাধারণত Flow State বা সম্পূর্ণভাবে কাজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যাই। এই পরিস্থিতিতে আমরা বর্তমান মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকি, যা আমাদেরকে হেডোনিক ট্রেডমিলের অতীত বা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়। যখন আপনি আপনার শখের কাজে মগ্ন থাকেন, তখন আপনি মুহূর্তের আনন্দে ডুবে থাকেন এবং বাহ্যিক চাপ বা ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে মুক্তি পান। এটি মানসিক শান্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী সুখের দিকে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ তার শখ হিসেবে ছবি আঁকে, সংগীত চর্চা করে, ফটোগ্রাফি করে, মাছ ধরে বা বাগান করে তাহলে সেই কাজের মধ্যে এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে, বাহ্যিক চাপ বা অসন্তোষ থেকে সে সাময়িকভাবে মুক্তি পায়।
  • অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন (Valuing Experiences Over Material Possessions): হেডোনিক ট্রেডমিল ধারণায়, আমরা সবসময় নতুন বস্তু বা আর্থিক সাফল্য অর্জনের জন্য ছুটতে থাকি। তবে, শখের কাজগুলো সাধারণত বস্তুগত অর্জনের চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি তৈরি করার দিকে মনোযোগ দেয়, যা আমাদের জীবনের স্থায়ী সুখ এনে দেয়। হেডোনিক ট্রেডমিলের বস্তুগত চাহিদার বিপরীতে, শখের কাজের মাধ্যমে তৈরি হওয়া অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ এনে দিতে পারে। বস্তুগত জিনিসের চেয়ে অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত আনন্দ অনেক বেশি স্থায়ী এবং তা আমাদের জীবনের মান বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো শখের ভ্রমণ বা হাইকিং-এর অভিজ্ঞতা একটি দামি জিনিস কেনার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সুখ দেয়, কারণ তা স্মৃতিতে থাকে এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
  • শিখন এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন (Learning and Personal Growth): শখের কাজগুলো সাধারণত আমাদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা, বা ব্যক্তিগত উন্নয়নের দিকে ধাবিত করে, যা আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ এবং তৃপ্তিময় করে। যখন আমরা শখের কোনো নতুন দিক শিখি বা চর্চা করি, তখন আমরা বাহ্যিক পুরস্কারের জন্য তা করি না, বরং নিজেদের উন্নয়নের জন্য, যা বাহ্যিক অর্জনের তুলনায় অনেক বেশি স্থায়ী হয়। এটি হেডোনিক ট্রেডমিলের চিরস্থায়ী বাহ্যিক অর্জনের লোভ থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো ফটোগ্রাফির শখ থাকে এবং সে তার শখের জন্য নিয়মিত ফটোগ্রাফি করে, তাহলে সে এই কাজের মাধ্যমে নতুন কৌশল শিখতে পারে এবং নিজের মধ্যে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। আবার কেউ নিজের ইচ্ছায় নতুন বাদ্যযন্ত্র শেখার চেষ্টা করে, সেটি তাকে আনন্দ দেবে এবং সে তার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, যা বাহ্যিক অর্জনের চেয়ে বেশি সন্তোষজনক হতে পারে।
  • সামাজিক সংযোগ এবং সম্পর্ক গড়া (Social Connection and Bonding): কিছু শখের কাজ আমাদের সামাজিকভাবে সংযুক্ত করে এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে, যা হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে মুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শখের কাজগুলো সাধারণত আমরা আমাদের পছন্দের মানুষদের সাথে ভাগাভাগি করতে পারি, যা আমাদের মানসিকভাবে সমৃদ্ধ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী তৃপ্তি এনে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বন্ধুর সাথে খেলাধুলা করা, পরিবারের সাথে রান্না করা, বা কোনো সৃজনশীল প্রকল্পে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে গভীর সামাজিক সংযোগ তৈরি হবে, যা মানসিক প্রশান্তি এনে দেবে।
  • মানসিক চাপ মুক্তি এবং সাময়িক বিরতি (Stress Relief and Break from Routine): শখের কাজগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাপ থেকে মুক্তি দেয়। কাজের চাপ, জীবনের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা বা ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যেও শখের কাজগুলো আমাদের মনকে শান্ত করে এবং মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি হেডোনিক ট্রেডমিলের নিরন্তর দৌড় থেকে আমাদেরকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেয়। শখের কাজগুলো আমাদের মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যারা রোজকার কাজের মধ্যে সঙ্গীত, খেলাধুলা বা  সৃজনশীল লেখালেখি করে, তারা বেশি চাপমুক্ত থাকতে পারে এবং হেডোনিক ট্রেডমিলের ক্রমাগত দৌড় থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে পারে।
  • জীবনের ভারসাম্য (Creating Balance in Life): শখের কাজগুলো আমাদের জীবনের কাজের চাপ এবং ব্যক্তিগত চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি আমাদেরকে হেডোনিক ট্রেডমিলের চিরন্তন দৌড়ের চেয়ে আরও ধীর এবং সুস্থির জীবনযাত্রা অনুসরণ করতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ রোজ কাজের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য বাগান করা বা মিউজিক শোনার মতো শখের কাজ করে, তাহলে তার মানসিক প্রশান্তি এবং জীবনধারায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।


উপসংহার

হেডোনিক ট্রেডমিলের ধারণা আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে আসে: সুখের অনুভূতি কখনও স্থায়ী হয় না, কারণ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগের অবস্থার উপর এটি নির্ভর করে। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী আমাদের শেখান যে, অভ্যস্ততা ও সুখের সাইকেল আমাদের অনুভূতিগুলিকে প্রভাবিত করে, যার ফলে আমরা নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সুখের সন্ধানে মগ্ন থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।


স্থায়ী সুখ পাওয়ার উপায় হিসেবে ধ্যান, ব্যায়াম, এবং সম্পর্কগুলোর মান উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুখের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং সুখের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে যে সুখের উৎস কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে আমরা আমাদের সুখী জীবনযাপনের জন্য তা কাজে লাগাতে পারি। সুখের বিজ্ঞান এবং এর দীর্ঘস্থায়িত্বের বিষয়গুলি উন্মোচন করে আমাদেরকে সচেতনতা প্রদান করে, যা হৃদয়ের শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সুখী সমাজ গঠনের পথে অগ্রসর হতে সহায়ক। এই নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা হেডোনিক ট্রেডমিলের প্রভাব, সুখের স্থায়িত্ব এবং সুখী হওয়ার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, যা আমাদের জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে। তাই, সুখের অনুভূতি ধরে রাখার জন্য আমাদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, এবং নতুন অভিজ্ঞতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে আমরা সত্যিকার অর্থে নিজেদের সুখী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।


Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। 

Post a Comment

0 Comments