ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বে আত্মরক্ষা, ফিটনেস এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য মার্শাল আর্ট একটি চমৎকার ও কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধু এক ধরনের যুদ্ধকলাই নয়, বরং শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক নিয়ন্ত্রণ এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি। প্রাচীন চীন, ভারত, জাপান ও কোরিয়াতে উদ্ভব হওয়া এই যুদ্ধশৈলীগুলো সময়ের বিবর্তনে আত্মরক্ষার উপায় থেকে একটি জীবনদর্শনে রূপ নিয়েছে। মার্শাল আর্ট চর্চার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের সীমা অতিক্রম করে কৌশলী, আত্মনির্ভর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
![]() |
মার্শাল আর্ট । Photo by olia danilevich |
প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মার্শাল আর্টের চর্চা শারীরিক ফিটনেস, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শারীরিক শক্তি, মানসিক সংযম ও আত্মরক্ষার দক্ষতার এক অনন্য সমন্বয় হলো মার্শাল আর্ট। শিশু থেকে শুরু করে প্রবীণ পর্যন্ত সবাই মার্শাল আর্টের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন। আধুনিক সমাজে যেখানে অপরাধপ্রবণতা ও অনিরাপত্তা দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেখানে আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্ট শেখা একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র কিংবা প্রতিদিনের জীবনে দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে মার্শাল আর্ট ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই নিবন্ধে আমরা মার্শাল আর্টের ইতিহাস, প্রকারভেদ, উপকারিতা এবং আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মার্শাল আর্ট কি?
মার্শাল আর্ট বলতে বোঝায় সুসংগঠিত এবং পদ্ধতিগতভাবে প্রশিক্ষিত যুদ্ধ কৌশল, যা আত্মরক্ষা, শারীরিক সুস্থতা, প্রতিযোগিতা এবং মানসিক বিকাশের উদ্দেশ্যে অনুশীলন করা হয়। এর উৎপত্তি প্রাচীন সভ্যতার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, যেখানে যোদ্ধারা নিজেদের এবং তাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য এই কৌশলগুলো আয়ত্ত করতো। সময়ের সাথে সাথে, এই কৌশলগুলো যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং একটি জীবন দর্শন এবং শৃঙ্খলামূলক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ‘Martial’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘Mars’ (রোমান যুদ্ধের দেবতা) থেকে, আর ‘Art’ শব্দের অর্থ শৈলী, কৌশল বা নৈপুণ্য। এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে ‘Martial Arts’ শব্দটির অর্থ যুদ্ধবিদ্যা বা আত্মরক্ষার শৈলী। বিশ্বজুড়ে প্রচলিত বিভিন্ন মার্শাল আর্ট শৈলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কারাতে, কুংফু, জুডো, তায়কোয়ানডো, মুই থাই, ক্রাভ মাগা ইত্যাদি। প্রতিটি শৈলীর রয়েছে স্বতন্ত্র কৌশল, দার্শনিক ভিত্তি ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, যা অনুশীলনকারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে উন্নত করে তোলে।
মার্শাল আর্টের চর্চা তিনটি প্রধান স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে গঠিত- আত্মরক্ষা, শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক শৃঙ্খলা। এটি শুধুমাত্র শারীরিক কৌশল শেখায় না, বরং একজন অনুশীলনকারী ধীরে ধীরে ধৈর্য, মনোসংযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ মানসিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়, যা জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এটি প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা হিসেবেও পরিচিত, যেমন- জুডো বা কারাতে অলিম্পিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান বিশ্বে মার্শাল আর্ট শুধুমাত্র একজন যোদ্ধা তৈরির জন্য নয়, এটি একজন ভালো মানুষ, শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি গড়ে তোলার এক দুর্দান্ত মাধ্যম।
মার্শাল আর্টের ইতিহাস
মার্শাল আর্টের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো, যা পৃথিবীর নানা প্রান্তের সংস্কৃতি, যুদ্ধনীতি ও আত্মরক্ষার কৌশলের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে। প্রায় ৪,০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে যুদ্ধ ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বিভিন্ন শারীরিক কৌশল ও শরীরচর্চা শুরু হয়। মিশর, গ্রীস, রোমের মতো সভ্যতায় কুস্তি ও বক্সিংয়ের মতো যুদ্ধ-ভিত্তিক খেলাধুলা প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে গ্রীকের প্যানক্রেশান ছিল একটি মিশ্র মার্শাল আর্ট এবং রোমান গ্ল্যাডিয়েটররা দর্শকদের বিনোদনের জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র লড়াই করতো। তবে, ভারতের কেরালায় উদ্ভূত কালারিপায়াত্তুকে মার্শাল আর্টের ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যময় ও উচ্চমানের একটি মার্শাল আর্ট শৈলী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতের কালারিপায়াত্তু, যোগা, ধ্যান, মল্লযুদ্ধ ও ধনুর্বিদ্যা, একইসঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, সবমিলিয়ে মার্শাল আর্টের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৫ম শতাব্দীতে এই সম্মিলিত বিদ্যাগুলি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে চীনে প্রবেশ করে এবং এগুলোর সমন্বয়ে শাওলিন মঠে "শাওলিন কুংফু"-র সূচনা হয়। শাওলিন মঠের ভিক্ষুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতির জন্য একটি ব্যায়াম ও আত্মরক্ষার কৌশলগুলিই পরবর্তীতে চীনা মার্শাল আর্টের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। শাওলিন কুংফুর পরবর্তিতে চীনে বিভিন্ন ধরণের মার্শাল আর্ট বিকশিত হয়েছে, যা প্রায়শই নির্দিষ্ট অঞ্চল, পরিবার বা দার্শনিক বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত। তাই চি চুয়ান, উইং চুন এবং বিভিন্ন ধরণের কুংফু এর কয়েকটি উদাহরণ। এই শৈলীগুলি শুধু শারীরিক কৌশলই নয়, এটি তাওবাদ এবং বৌদ্ধধর্মের মতো দার্শনিক ধারণাগুলিকেও প্রকাশ করে।
চীনের মার্শাল আর্ট প্রভাব ফেলেছিল জাপান ও কোরীয়ার উপর। জাপানে ১২শ শতাব্দীতে সামুরাই যোদ্ধাদের উত্থান মার্শাল আর্টের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বুশিদো (যোদ্ধার পথ) ছিল সামুরাইদের নীতিশাস্ত্র, যা আনুগত্য, সাহস, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং সম্মানের উপর জোর দিত। সুমো, জিউ-জিৎসু, কেনদো (তরোয়াল চালনা) এবং জুডো (জিউ-জিৎসুর একটি আধুনিক রূপ) জাপানের বিখ্যাত মার্শাল আর্ট। পরবর্তিতে কোরিয়ায় তায়কোয়ান্দো এবং হাপকিডো সহ নিজস্ব স্বতন্ত্র মার্শাল আর্ট শৈলী বিকশিত হয়েছে। তায়কোয়ান্দো, বিশেষ করে এর গতিশীল কিক এবং ধর্মীয় অনুশীলনের উপর জোর দেওয়ার জন্য পরিচিত, কোরিয়ার জাতীয় খেলাধুলা এবং একটি জনপ্রিয় বিশ্বব্যাপী মার্শাল আর্ট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, থাইল্যান্ডে মুয়ায় থাই (থাই বক্সিং), ইন্দোনেশিয়ায় পেনকাক সিলাট, ফিলিপাইনে কালী, মায়ানমারের লেথওয়ে এবং ভিয়েতনামে ভোভিনামের মতো অনন্য এবং মারাত্মক মার্শাল আর্ট বিকশিত হয়েছে। এই শৈলীগুলি প্রায়শই স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং যুদ্ধের পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ইউরোপেও মার্শাল আর্টের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে, যদিও এটি এশিয়ার মতো ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত বা চর্চিত নয়। মধ্যযুগে নাইটরা তরোয়াল চালনা, বর্শা চালনা এবং কুস্তির মতো বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত ছিল। ফেন্সিং এবং বক্সিং আধুনিক ইউরোপীয় মার্শাল আর্টের উদাহরণ।
আধুনিক মার্শাল আর্ট
আধুনিক মার্শাল আর্ট আজ এক বৈশ্বিক, বহুমাত্রিক এবং বিজ্ঞাননির্ভর অনুশীলনে রূপ নিয়েছে, যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে প্রাচীন যুদ্ধকলার ঐতিহ্যে। সময়ের বিবর্তনে এটি কেবল আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছে একটি পূর্ণাঙ্গ শারীরিক ব্যায়াম, মানসিক উন্নয়নের মাধ্যম, প্রতিযোগিতামূলক খেলা এবং জীবনদর্শনের একটি রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগে আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা, ফিটনেস সচেতনতা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে মার্শাল আর্ট বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্রুস লি-র অবদান মার্শাল আর্টকে একটি বৈশ্বিক সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত করে তোলে। টেলিভিশন, সিনেমা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্রুস লির পাশাপাশি জ্যাকি চ্যান, জেট লি, জিন-ক্লদ ভ্যান ডাম ও টনি জা-এর মতো কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বরা এটিকে শুধু জনপ্রিয়ই করেননি, বরং একে একটি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর ফলে কুংফু, কারাতে, তায়কোয়ান্দো, মুয়ায় থাই, বক্সিং ও ফেন্সিং- সবই আধুনিক মার্শাল আর্টের ছাতার নিচে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে মার্শাল আর্ট শুধুমাত্র আত্মরক্ষার কৌশল নয়, বরং একটি খেলাধুলা, চর্চা এবং জীবনবোধ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত।
বর্তমানে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ আরও পেশাদার ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। মিক্সড মার্শাল আর্টস (MMA) এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় আধুনিক শৈলীগুলোর একটি, যেখানে বক্সিং, কিকবক্সিং, ব্রাজিলিয়ান জুজিৎসু, রেসলিং ও জুডোর মতো কৌশল একত্রে ব্যবহৃত হয়। ইউএফসি (UFC) এবং Bellator-এর মাধ্যমে এটি বৈশ্বিক বিনোদন ও প্রতিযোগিতার অন্যতম রূপে পরিণত হয়েছে। এছাড়া, ব্রুস লি প্রতিষ্ঠিত জিট কুন ডো (Jeet Kune Do) এবং এর এর মূল দর্শন “যতটা কার্যকরী, ততটাই সরল” একটি হাইব্রিড শৈলী হিসেবে সমানভাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। আধুনিক প্রশিক্ষণে বিজ্ঞানসম্মত ফিটনেস রুটিন, পুষ্টিবিধি, মানসিক কৌশল এবং নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার এটিকে শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষের জন্যও উপযোগী করে তুলেছে। আজকের দিনে ভার্চুয়াল ট্রেনিং, মোশন ট্র্যাকিং ও অনলাইন কোর্সের সাহায্যে আজ মার্শাল আর্ট চর্চা আরও সহজলভ্য ও সর্বজনীন। সবমিলিয়ে আধুনিক মার্শাল আর্ট আত্মরক্ষার কৌশল এর পাশাপাশি আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তার এক পূর্ণাঙ্গ জীবনচর্চা।
মার্শাল আর্টের প্রকারভেদ
মার্শাল আর্ট একটি বিস্তৃত শৈলীর সমষ্টি, যার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে নির্দিষ্ট কৌশল, দর্শন, সংস্কৃতি এবং অনুশীলন পদ্ধতির ভিত্তিতে। প্রতিটি প্রকারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও সবগুলোই মূলত আত্মরক্ষা, শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে। সাধারণভাবে, মার্শাল আর্টের ধরনগুলিকে পাঁচটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়:
১. স্ট্রাইকিং বা আঘাতভিত্তিক মার্শাল আর্ট
২. গ্র্যাপলিং বা মল্লযুদ্ধভিত্তিক মার্শাল আর্ট
৩. অস্ত্রভিত্তিক মার্শাল আর্টস
৪. অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস
৫. হাইব্রিড মার্শাল আর্টস
১. স্ট্রাইকিং বা আঘাতভিত্তিক মার্শাল আর্ট
স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্ট এমন এক ধরনের যুদ্ধকলা, যেখানে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য মূলত হাত, পা, কনুই এবং হাঁটু ব্যবহার করা হয়। এই স্টাইলে ঘুষি, লাথি, ব্লক এবং কাউন্টার অ্যাটাকের মাধ্যমে আত্মরক্ষা ও আক্রমণের কৌশল শেখানো হয়। স্ট্রাইকিং ভিত্তিক মার্শাল আর্টে দ্রুত প্রতিক্রিয়া, নিখুঁত টাইমিং এবং শারীরিক ফিটনেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের স্টাইলে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক মনোযোগ এবং ধৈর্যের চর্চাও হয়। স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্টস-এর প্রধান জনপ্রিয় স্টাইলগুলি হলো:
কারাতে (Karate):
কারাতে হলো জাপানের একটি প্রাচীন মার্শাল আর্ট যা হাত ও পায়ের ঘুষি, লাথি, ব্লক এবং পাল্টা আঘাতের কৌশল শেখায়। এটি মূলত আত্মরক্ষার জন্য তৈরি হলেও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক খেলার একটি জনপ্রিয় শাখা হিসেবে পরিচিত। কারাতের মূল লক্ষ্য হলো শরীর ও মনকে শক্তিশালী করা, যাতে একদিকে শারীরিক ফিটনেস বাড়ে এবং অন্যদিকে মনোসংযোগ, ধৈর্য ও শৃঙ্খলা অর্জিত হয়। কারাতে বিভিন্ন স্টাইল ও স্কুলে বিভক্ত, যার মধ্যে শোতোকান, শোরিন রিউ, গোজুরু-রিউ ওয়াডো-রিউ ইত্যাদি অন্যতম। শোতোকান ও শোরিন রিউ কারাতের বৈশিষ্ট্যগুলোর সংমিশ্রণে গঠিত ‘সিতো রিউ’ একটি বিশিষ্ট শৈলী। এই শৈলিটি ১৯৩০-এর দশকে কেনওয়া মাবুনি (Kenwa Mabuni) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি কারাতে ধারার রয়েছে স্বতন্ত্র কৌশল, দর্শন ও অনুশীলন পদ্ধতি, কিন্তু এর মূল ভিত্তি আত্মরক্ষা, আত্মনির্ভরতা এবং অহিংস চেতনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ‘কাতা’ নামক ধারাবাহিক ও কাঠামোবদ্ধ চলন শেখানো হয়, যা শরীরের সঠিক ভঙ্গি, গতি ও কৌশলগত দক্ষতা গড়ে তোলে। পাশাপাশি ‘কুমিতে’ বা সঙ্ঘর্ষমূলক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের বাস্তব প্রয়োগ শেখানো হয়, যা আত্মবিশ্বাস ও প্রতিক্রিয়াশক্তি বাড়াতে সহায়ক। কারাতে শেখার মাধ্যমে শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি, মানসিক দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং সম্মানের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ কারাতেকে একটি জীবনধারা হিসেবে গ্রহণ করেছে, যা শৃঙ্খলা, সম্মান এবং আত্মরক্ষার এক অনন্য সমন্বয়।
তায়কোয়ানডো (Taekwondo):
তায়কোয়ানডো হলো দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় মার্শাল আর্ট এবং বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত একটি আধুনিক আত্মরক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক খেলা। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত, শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট লাথির কৌশল, যা প্রতিপক্ষকে আঘাত করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর। “তায়ে” অর্থ পা, “কোয়ান” অর্থ হাত, আর “ডো” অর্থ পথ বা কৌশল, যার মাধ্যমে তায়কোয়ানডোকে “পা ও হাতের পথ” হিসেবে অনুবাদ করা হয়। তায়কোয়ানডোর অনুশীলন শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে না, এটি মনোবল, ধৈর্য, সম্মান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো গুণাবলীও বিকাশ করে। এটি অলিম্পিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ২০৫টি দেশে তায়কোয়ানডোর চর্চা অত্যন্ত জনপ্রিয়। তায়কোয়ানডোর প্রশিক্ষণে কাতা (ফর্ম), স্প্যারিং (লড়াই), ব্রেকিং (বস্তুর ভাঙন) এবং আত্মরক্ষামূলক কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই মার্শাল আর্ট শিক্ষার্থীদের দ্রুততা, শক্তি ও ফ্লেক্সিবিলিটি বৃদ্ধি করে, যা বাস্তব জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষায় সহায়ক। তায়কোয়ানডো শেখার মাধ্যমে একজন অনুশীলনকারী শারীরিকভাবে ফিটের পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে, যা তার সার্বিক ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কুংফু (Kung Fu):
চীনের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ মার্শাল আর্ট কুংফু, যা আত্মরক্ষার পাশাপাশি দেহ, মনের ভারসাম্য ও প্রাণশক্তি (Qi) নিয়ন্ত্রণে একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শনের প্রতিফলন। কুংফু শব্দের অর্থ হলো “শ্রম ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা,” যা যুদ্ধকলা এবং জীবনধারার পরিচায়ক। কুংফুর অসংখ্য শৈলী রয়েছে, যার মধ্যে শাওলিন কুংফু, উইং চুন, তাওইস্ট কুংফু, টিগুয়া কুংফু, ব্যাগুয়া কুংফু, হাং গার, উশু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি শৈলীর নিজস্ব অনুশীলন পদ্ধতি, কায়িক গঠন, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ এবং মনোসংযোগের কৌশল বিদ্যমান। শাওলিন মঠ থেকে উৎপত্তি হওয়া কুংফু তার ফিলোসফি ও ধ্যান পদ্ধতির জন্য বিশ্ববিখ্যাত। কুংফু চর্চার মাধ্যমে শরীরের নমনীয়তা, শক্তি, ধৈর্য ও মনোবলের উন্নতি ঘটে। এটি নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে চিনে নেয়া ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম। আধুনিককালে, চলচ্চিত্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কুংফু বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং এটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
মুই থাই (Muay Thai):
মুই থাই হলো থাইল্যান্ডের জাতীয় মার্শাল আর্ট এবং বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও শক্তিশালী স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্ট। এটিকে “আট অঙ্গের যুদ্ধশিল্প” বলা হয়, কারণ এতে হাত, পা, হাঁটু এবং কনুই- মোট আটটি শরীরের অংশকে ব্যবহার করে আঘাত করা হয়। মুই থাই-এর মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে দ্রুত ও কার্যকরীভাবে পরাস্ত করা, যা আত্মরক্ষা ও প্রতিযোগিতার জন্য এক বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে কঠোর শারীরিক কসরত, স্ট্রাইকিং টেকনিক, কৌশলগত লড়াই এবং মানসিক দৃঢ়তার উন্নতি অন্তর্ভুক্ত। মুই থাইয়ের ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো, যা থাই সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আজকের দিনে মুই থাই শুধু থাইল্যান্ডে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বিশেষ করে MMA (Mixed Martial Arts) ফাইটারদের মধ্যে। মুই থাই অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরের শক্তি ও নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়, মানসিক ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে, যা অনুশীলনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুগঠিত করে তোলে।
লেথওয়েই (Lethwei):
লেথওয়েইকে "বার্মিজ বক্সিং" নামেও ডাকা হয়, মিয়ানমারের প্রাচীন ও আক্রমণাত্মক মার্শাল আর্টগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি মূলত একটি স্ট্রাইকিং-ভিত্তিক যুদ্ধশৈলী, যার বৈশিষ্ট্য হলো পাঁচটি অস্ত্রের ব্যবহার: মুষ্টি, পা, হাঁটু, কনুই এবং মাথা। লেথওয়েই-তে হেডবাট বা মাথা দিয়ে আঘাত করা বৈধ এবং নিয়মিত ব্যবহৃত হয়, যা একে অন্যান্য স্ট্রাইকিং আর্টস, যেমন- মুই থাই বা কিকবক্সিং থেকে আলাদা করে তোলে। লেথওয়েই-এর লড়াইগুলো অনেক সময় গ্লাভস ছাড়াই, শুধু ব্যান্ডেজ পেচিয়ে করা হয়, ফলে এর ধাক্কা ও তীব্রতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ঐতিহ্যগতভাবে লেথওয়েই একটি রিংয়ে খালি হাতে দুই যোদ্ধার মধ্যে হিংস্র ও সংযত কৌশলের সংঘর্ষ, যেখানে প্রতিপক্ষকে নকআউট করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে এটি শুধু শারীরিক না, এর প্রতিটি আঘাতের পেছনে থাকে দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস এবং মুহূর্তের সঠিক মূল্যায়নের দক্ষতা। বর্তমানে লেথওয়েই আধুনিক নিয়মে রূপান্তরিত হলেও, এর মূল গঠন ও আক্রমণাত্মক বৈশিষ্ট্য অটুট রয়েছে। যারা আক্রমণাত্মক, সাহসী এবং সীমার বাইরে গিয়ে লড়াই করতে চায়, তাদের জন্য লেথওয়েই একটি চূড়ান্ত স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্টসের উদাহরণ।
কালারিপায়াত্তু (Kalaripayattu):
কালারিপায়াত্তু ভারতের প্রাচীনতম মার্শাল আর্টগুলোর একটি, যা মূলত দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী যুদ্ধকলা। এর ইতিহাস প্রায় ২০০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়, যা ভারতের মার্শাল আর্ট ঐতিহ্যের মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। কালারিপায়াত্তুকে বিশ্বের সব মার্শাল আর্টের উৎস হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করেন। কালারিপায়াত্তু মানে “কালারি” অর্থাৎ প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র এবং “পায়াত্তু” অর্থ যুদ্ধ বা যুদ্ধশৈলী। এটি শারীরিক কসরত, অস্ত্র পরিচালনা, স্ট্রাইকিং, ফ্লেক্সিবিলিটি ও মানসিক প্রশিক্ষণের এক বিস্তৃত সমন্বয়। কালারিপায়াত্তুতে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সজীব এবং সুগঠিত করে তোলা হয় কৌশলগত শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যমে। এতে হাত, পা, হাঁটু, কনুইয়ের ব্যবহার করে ফেলা দেওয়া, অস্ত্র চালনা এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের নানা ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত থাকে। এছাড়াও লাঠি, তলোয়ার, ডগর, বর্শা সহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র ব্যবহার শেখানো হয়। কালারিপায়াত্তু শারীরিক সুস্থতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মনোযোগ এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির একটি পূর্ণাঙ্গ পথ। এই মার্শাল আর্টের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীরা শুধু শারীরিক শক্তি অর্জন করে না, পাশাপাশি ধ্যান ও আধ্যাত্মিক উন্নতিও লাভ করে। আজকের আধুনিক যুগেও কালারিপায়াত্তু মার্শাল আর্টস ও হোলিস্টিক হেলথ প্র্যাকটিস হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
বক্সিং (Boxing):
বক্সিং হলো এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্ট, যেখানে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য মূলত ঘুষির (Punch) উপর নির্ভর করা হয়। এ খেলায় কেবল দুটি হাত ব্যবহার করেই প্রতিযোগীরা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে প্রতিপক্ষের মাথা ও শরীরের নির্ধারিত অংশে আঘাত করেন। বক্সিংয়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধুমাত্র কৌশলগত আঘাত নয়, বরং প্রতিপক্ষের গতিবিধি পড়া, প্রতিক্রিয়া সময়ের নিখুঁত ব্যবহার এবং আত্মরক্ষার চমৎকার সমন্বয়। প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিকে বক্সিংয়ের অস্তিত্ব থাকলেও, আধুনিক বক্সিংয়ের ভিত্তি গড়ে ওঠে ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডে, যেখানে প্রথমবারের মতো নিয়মকানুন প্রণয়ন করা হয়। আধুনিক ক্রীড়াবিশ্বে বক্সিং খেলার পাশাপাশি শারীরিক ফিটনেস, আত্মরক্ষা ও মানসিক দৃঢ়তার এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম। এটি শরীরের গতি, ভারসাম্য, স্ট্যামিনা ও রিফ্লেক্স বাড়াতে সাহায্য করে। একাধিক পাঞ্চের ধরণ (যেমন: জ্যাব, হুক, ক্রস, আপারকাট) এবং রক্ষণাত্মক কৌশল (যেমন: ব্লক, স্লিপ, বব ও উইভ) এই শৈলীতে ব্যবহৃত হয়। বক্সিং বর্তমানে শুধু অলিম্পিক ও পেশাদার খেলার ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী আত্মরক্ষা, কার্ডিও ফিটনেস ও কনফিডেন্স বৃদ্ধির জন্যও বহুল চর্চিত একটি মার্শাল আর্ট।
কিকবক্সিং (Kickboxing):
কিকবক্সিং হলো একটি আধুনিক স্ট্রাইকিং মার্শাল আর্ট, যা ঘুষি ও লাথির কৌশলকে একত্রিত করে উচ্চ গতি, শক্তি এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেয়। মূলত বক্সিংয়ের ঘুষির কৌশলকে ভিত্তি করে লাথির সঙ্গে মিলিয়ে এটি তৈরি হয়েছে, যা আত্মরক্ষা এবং ক্রীড়া উভয়ের জন্যই উপযোগী। কিকবক্সিং অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে শক্তিশালী আঘাত করা যায়, যেমন- সামনের লাথি, পাশের লাথি, হাঁটু দিয়ে আঘাত ইত্যাদি। ১৯৬০-এর দশকে জাপানে এবং পশ্চিমা দেশে কিকবক্সিং শুরু হলেও দ্রুত এটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিকবক্সিংয়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর উচ্চ গতির কম্বো আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা, যা একযোগে শক্তি, গতি ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটায়। এটি শরীরের স্থিতিস্থাপকতা, শক্তি, ধৈর্য ও প্রতিক্রিয়া সময় উন্নত করার পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তাও বৃদ্ধি করে। আধুনিক মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA) এবং প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে কিকবক্সিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া এটি কার্ডিও ফিটনেস ও ওজন কমানোর জন্যও বেশ জনপ্রিয়। কিকবক্সিং শিক্ষার্থীরা শারীরিকভাবে প্রচন্ড সক্ষম এবং তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তিও ব্যাপক।
তাইকিয়ন (Taekkyeon):
তাইকিয়ন একধরনের ঐতিহাসিক কোরিয়ান আত্মরক্ষা কৌশল, যেখানে ছন্দোময় ও নৃত্যসদৃশ্য গতিতে আত্মরক্ষা ও আক্রমণ কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এটি কোরীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আত্মরক্ষা, খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার উপায় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে চর্চিত হয়ে এসেছে। তাইকিয়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সুনির্দিষ্ট ‘পুমসে’ বা চলাচলের ধারা, যেটি ছন্দবদ্ধভাবে শরীরকে একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল শেখায়। এতে লাথি মারা, টেনে ফেলে দেওয়া, ধাক্কা দেওয়া এবং ফেলে দেওয়ার মতো বহু কৌশল রয়েছে, কিন্তু এর গতি সবসময় নমনীয় এবং ছন্দময়, যা অন্যান্য মার্শাল আর্ট থেকে ব্যতিক্রম। কোরিয়া সরকার ১৯৮৩ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়াকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পরে ইউনেসকো ২০১১ সালে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। তাইকিয়ন শুধু আত্মরক্ষার কৌশল নয়, এটি কোরিয়ান সংস্কৃতির একটি জীবন্ত নিদর্শন। অনেক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এখন এটিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলছে, যাতে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প আবারও বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পায়। তাইকিয়ন এমন একটি শৈলী যা আত্মরক্ষা, ছন্দ, সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যকে একত্রে ধারণ করে।
সাভাতে (Savate):
সাভাতে হলো ফ্রান্সের একটি ঐতিহ্যবাহী কিকবক্সিং স্টাইল, যা "ফ্রেঞ্চ বক্সিং" নামেও পরিচিত। ১৮-১৯ শতকে ফরাসি নাবিকদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে এর সূচনা হয় এবং পরে এটি প্যারিস শহরের রাস্তায় অপরাধ দমন ও আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো। সাভাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর সুপরিকল্পিত লাথি ও ঘুষির কৌশল, যেখানে বক্সিংয়ের হাতের কৌশল এবং ফরাসি ফুটওয়ার-স্টাইল কিকের সমন্বয় দেখা যায়। এটি একমাত্র কিকবক্সিং শৈলী যেখানে খেলোয়াড়রা জুতা পরে প্রতিযোগিতা করে, যা লাথির কার্যকারিতা ও ভিন্নতা আরও বাড়িয়ে তোলে। সাভাতে প্রতিটি কৌশল নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ও নিখুঁত ব্যালান্সের উপর ভিত্তি করে শেখানো হয় এবং এটি একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক ফিটনেস, গতি, কৌশল ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। আধুনিক সাভাতে এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মার্শাল আর্ট ফর্ম এবং ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতামূলক খেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। আত্মরক্ষা, ক্রীড়া ও শৈল্পিক দক্ষতার এক অনন্য মিশ্রণ হিসেবে সাভাতে আজ একটি সম্মানিত এবং কার্যকর যুদ্ধশৈলী।
২. গ্র্যাপলিং বা মল্লযুদ্ধভিত্তিক মার্শাল আর্ট
গ্র্যাপলিং মার্শাল আর্টস হলো এমন এক ধরনের যুদ্ধশৈলী যেখানে মূলত শারীরিক ধরাধরি, লক করা, জমিতে ফেলা ও সাবমিশন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এই শৈলীতে হাতাহাতি বা ঘুষি-লাথির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় শরীরের কন্ট্রোল ও প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। গ্র্যাপলিং স্টাইলে একজন যোদ্ধা শারীরিকভাবে শক্তিশালী না হলেও, কৌশলগত দক্ষতা ও ধৈর্যের মাধ্যমে সহজেই বড় শক্তির প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে। এটি আত্মরক্ষার পাশাপাশি অলিম্পিক খেলা এবং মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্র্যাপলিং শৈলী অনুশীলনের মাধ্যমে ফিটনেস, নমনীয়তা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং এটি বিশেষ করে যারা বাস্তব জীবন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা চান তাদের জন্য আদর্শ। গ্র্যাপলিং মার্শাল আর্টস-এর প্রধান জনপ্রিয় স্টাইলগুলি হলো:
জুডো (Judo):
জুডো একটি জাপানি মার্শাল আর্ট, যার মূল ভিত্তি হলো প্রতিপক্ষের শক্তিকে ব্যবহার করে তাকে পরাস্ত করা। "জুডো" শব্দের অর্থ "নম্র পথ" বা "সৌম্য উপায়" এবং এটি ১৮৮২ সালে জিগোরো কানো (Jigoro Kano) নামক এক শিক্ষাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মূলত আত্মরক্ষামূলক একটি কৌশল, যেখানে প্রতিপক্ষকে ঘুষি বা লাথি না মেরে বরং ধাক্কা, ফেলে দেওয়া, চোক হোল্ড ও অন্যান্য গ্র্যাপলিং কৌশলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জুডোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- শরীরের ভারসাম্য, সময়জ্ঞান, গতি এবং কৌশলের নিখুঁত সমন্বয়। এখানে যোদ্ধা শিখে কিভাবে নিজের শক্তি না খরচ করে প্রতিপক্ষের শক্তিকে ঘুরিয়ে তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা যায়। জুডোতে ‘থ্রো’ বা ফেলে দেওয়া কৌশল এবং ‘গ্রাউন্ড ফাইটিং’ বা মাটিতে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র একটি যুদ্ধশৈলী নয়, বরং নৈতিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা, ধৈর্য এবং আত্মসম্মানের এক অনন্য পথ। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক খেলা হিসেবেও স্বীকৃত এবং বিশ্বব্যাপী হাজারো শিক্ষার্থী এই শৈলীতে প্রশিক্ষিত হচ্ছে। আত্মরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখানোর পাশাপাশি জুডো শারীরিক ফিটনেস ও মানসিক দৃঢ়তা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইকিডো (Aikido):
আইকিডো একটি জাপানি আত্মরক্ষা কৌশল, যেখানে আক্রমণকারীর শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিরোধ শেখানো হয়। ‘আইকিডো’ শব্দটি তিনটি অংশে বিভক্ত- ‘আই’ মানে ঐক্য বা সামঞ্জস্য, ‘কি’ মানে প্রাণশক্তি এবং ‘ডো’ মানে পথ বা জীবনধারা, যার সম্মিলিত অর্থ দাঁড়ায় ‘শক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলার পথ’। ২০শ শতকের শুরুর দিকে মোরিহেই উয়েশিবা এই শৈলীর সূচনা করেন। আইকিডোর মূল দর্শন হলো সহিংসতা পরিহার করে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনা, যেখানে গ্র্যাপলিং, থ্রো ও জয়েন্ট লকের মতো কৌশল ব্যবহার করা হয়। এখানে পান্ছ বা কিকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখানে শরীর ও মনকে একত্রে ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণভাবে সংঘর্ষ মোকাবিলা করার উপায় শিখানো হয়ে। এই শৈলী শুধু আত্মরক্ষার একটি মাধ্যম নয় বরং আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, স্থিরতা ও অন্তর্মুখী শক্তি জাগ্রত করার একটি অনুশীলন। আধুনিক বিশ্বে আইকিডো একটি আত্মরক্ষার উপযোগী শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও অনুশীলিত হচ্ছে।
ব্রাজিলিয়ান জিউ-জিৎসু (Brazilian Jiu-Jitsu বা BJJ):
BJJ একটি আধুনিক মার্শাল আর্ট ও আত্মরক্ষার সিস্টেম। গ্রাউন্ড ফাইটিং ও ক্লোজ রেঞ্জ কৌশলের সমন্বয়ে গঠিত, যা প্রতিপক্ষকে গ্রাউন্ডে নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রয়োগ করে একটি আধিপত্যপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেন এবং জয়েন্ট লক বা চোকহোল্ড-এর মতো সাবমিশন কৌশল প্রয়োগ করে তাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। আত্মরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর এই শৈলী শক্তির চেয়ে কৌশল ও লিভারেজকে অধিক গুরুত্ব দেয়। ব্রাজিলিয়ান জিউ-জিৎসুর মূল ভিত্তি হলো জাপানি জিউ-জিৎসু ও জুডো। ২০শ শতকের শুরুতে গ্রেসি পরিবার ব্রাজিলে এসে এটিকে নিজস্ব কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নতুনভাবে বিকশিত করে। এই শৈলীতে শারীরিক শক্তির বদলে কৌশলগত অবস্থান, লিভারেজ এবং সঠিক টাইমিংয়ের গুরুত্ব বেশি, যা একজন অপেক্ষাকৃত ছোট বা দুর্বল প্রতিপক্ষকেও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে সফল হতে সাহায্য করে। BJJ-র অনুশীলনে থ্রোয়ের চেয়ে গ্রাউন্ড ফাইটিং, গার্ড পজিশন, স্কেপিং, জয়েন্ট লক ও চোক হোল্ডের মতো কৌশল বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি একটি “লাইভ-স্প্যারিং” বা রোলিং-ভিত্তিক মার্শাল আর্ট, যেখানে প্রতিদিনই বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করা যায়।
সাম্বো (Sambo):
সাম্বো একটি রাশিয়ান যুদ্ধশৈলী যা মূলত আত্মরক্ষা এবং সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০শ শতকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে উদ্ভাবিত হয়। "Sambo" শব্দটি রাশিয়ান “SAMozashchita Bez Oruzhiya” (সামোজাশ্চিতা বেজ অরুজিয়া) থেকে এসেছে, যার অর্থ “অস্ত্র ছাড়া আত্মরক্ষা”। এই শৈলীতে জুডো, গ্রিক-রোমান কুস্তি এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ইউরেশিয়ান কুস্তি শৈলীর সংমিশ্রণ রয়েছে। সাম্বোর দুটি প্রধান ধারা রয়েছে: স্পোর্ট সাম্বো, যা অনেকটা অলিম্পিক জুডোর মতো দেখতে এবং কমব্যাট সাম্বো, যা আত্মরক্ষা, পুলিশ বা মিলিটারি ব্যবহারের জন্য তৈরি। এতে ঘুষি, লাথি ও সবধরনের সাবমিশন কৌশল অনুমোদিত। কমব্যাট সাম্বো আজকের MMA-র প্রাথমিক ভিত্তিগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর অনুশীলনে গ্র্যাপলিং, থ্রো, জয়েন্ট লক ও রেসলিং টেকনিকগুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, বিশেষত রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে। সাম্বো একজন যোদ্ধাকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে দক্ষ করে তোলে না, পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও সংকটময় পরিস্থিতিতে কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে তোলে।
শুয়াই জিয়াও (Shuai Jiao):
শুয়াই জিয়াও হলো চীনের সবচেয়ে প্রাচীন মার্শাল আর্ট শৈলীর একটি, যা মূলত গ্র্যাপলিং, টেকডাউন ও থ্রো কৌশলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর ইতিহাস প্রায় ৪,০০০ বছর পুরোনো, যার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন চীনা সামরিক ক্রীড়া “জিয়াওদি”-তে, যা রাজদরবার ও যুদ্ধবিদ্যায় ব্যবহৃত হতো। শুয়াই জিয়াওয়ের অর্থ "ফেলার কৌশল" এবং এর মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন গ্র্যাপলিং টেকনিক, লক ও কৌশল প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করা ও মাটিতে ফেলে দেওয়া। এতে ব্যবহার হয় গতিশীল পদচারণা, ভারসাম্যহীনতা তৈরি, কাঁধ ও কোমরের মোচড় এবং আকর্ষণাত্মক থ্রো টেকনিক, যা অনেকটা জুডো ও রেসলিং-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও নিজস্ব চীনা ঐতিহ্যে ভরপুর। এটি বিভিন্ন চীনা মার্শাল আর্ট, যেমন- কুংফু বা সন্দার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে অনেকে মনে করেন। আধুনিক যুগে শুয়াই জিয়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে। এর দৃষ্টিনন্দন থ্রো কৌশল, শারীরিক দক্ষতা ও ঐতিহ্যবাহী কৌশলের সম্মিলন নতুন প্রজন্মকে আকর্ষিত করছে। এটি শারীরিক ক্রীড়া, যুদ্ধশৈলী এবং চীনা সংস্কৃতির জীবন্ত নিদর্শন।
পেহলোওয়ানি (Pehlwani):
পেহলোওয়ানি হলো উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুস্তি বা রেসলিং-এর একটি শৈলী, যা মুঘল আমলে পারস্যের "পাহলেভানি" এবং ভারতীয় মালখাম্ব বা আখড়ার দেশীয় কুস্তির সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে। একে "কুস্তি" নামেও ডাকা হয় এবং এটি শত শত বছর ধরে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা অঞ্চলে প্রচলিত। পেহলোওয়ানি-এর লড়াই সাধারণত একটি মাটি বা কাদামাটির আখড়ায় হয়, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে গ্র্যাপলিং, হোল্ড, টেকডাউন এবং পিনিং কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই শৈলীর মূলত লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণভাবে পিঠ মাটিতে ঠেকিয়ে ফেলা। পেহলোওয়ানদের (কুস্তিগীরদের) জীবনশৈলী অত্যন্ত কঠোর ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে গড়ে ওঠে, তারা নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, বিশেষ আহার (যেমন: ঘি, দুধ, বাদাম) ও কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে শরীর ও মন গঠনে ব্রতী থাকেন। এদের অধিকাংশই "গুরু"-এর তত্ত্বাবধানে আখড়ায় প্রশিক্ষণ নেন। এই মার্শাল আর্ট আত্মসংযম, শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। যদিও আধুনিক কুস্তি ও আন্তর্জাতিক রেসলিং-এর কারণে পেহলোওয়ানি তার ঐতিহ্যগত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তবুও এটি আজও বহু অঞ্চলে জীবন্ত এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সংরক্ষিত। ভারতের গ্রামীণ ক্রীড়া উৎসব, পাকিস্তানের লোকসংস্কৃতি, এমনকি বাংলাদেশেও ঐতিহ্যবাহী কুস্তি প্রতিযোগিতায় পেহলোওয়ানি এখনও সম্মানজনক স্থান ধরে রেখেছে।
রেসলিং (Wrestling):
রেসলিং একটি প্রাচীন ও অত্যন্ত প্রভাবশালী গ্র্যাপলিং ভিত্তিক মার্শাল আর্ট, যার মূল লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলা, নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এবং সাবমিশনে বাধ্য করা। এটি মূলত শারীরিক শক্তি, ভারসাম্য, কৌশল ও সময়জ্ঞান নির্ভর একটি যুদ্ধশৈলী, যা প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আলাদা আলাদা রূপে গড়ে উঠেছে। গ্রিক-রোমান ও ফ্রিস্টাইল রেসলিং হচ্ছে আধুনিক অলিম্পিকের অংশ, যেখানে প্রতিপক্ষকে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে মাটিতে পিন করা বা স্কোরের মাধ্যমে জয়ী হতে হয়। রেসলিংয়ের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লিঞ্চিং, টেকডাউন, রিভার্সাল, ট্রিপ ও পিন- যেগুলো একজন যোদ্ধাকে খুব কাছ থেকে প্রতিপক্ষকে দমন করার দক্ষতা প্রদান করে। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা, পাশাপাশি আত্মরক্ষা ও MMA-এর জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। দক্ষ রেসলার তার ভারসাম্য বজায় রেখে দ্রুত গতিতে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলার পাশাপাশি নিচু অবস্থান থেকেও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই রেসলিং শক্তি, নিখুঁত কৌশল ও বিচক্ষণতার সমন্বয়ে একটি আত্মরক্ষার শিল্প।
গ্রেকো-রোমান রেসলিং (Greco-Roman Wrestling):
গ্রেকো-রোমান রেসলিং হলো একটি ঐতিহ্যবাহী এবং অলিম্পিক স্বীকৃত মার্শাল আর্ট। এই শৈলীতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে কেবল বাহু, হাত ও শরীরের উপরের অংশ ব্যবহার করার যায় এবং পায়ের ব্যবহার এবং কোমর থেকে নিচের অংশে আঘাত নিষিদ্ধ। গ্রেকো-রোমান রেসলিংয়ে প্রতিযোগীরা মূলত লক, থ্রো, টেকডাউন এবং ক্লিঞ্চিং কৌশল প্রয়োগ করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। এই রেসলিং স্টাইলের ইতিহাস প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধশৈলীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং আধুনিক অলিম্পিক গেমসের অন্যতম মূল প্রতিযোগিতা। গ্রেকো-রোমান রেসলিং শারীরিক শক্তি, ভারসাম্য, কৌশলগত চিন্তা ও ধৈর্যের এক অনন্য সমন্বয়। গ্রেকো-রোমান রেসলিং শারীরিক লড়াই, যোদ্ধার গতি, সময়ের মূল্যায়ন ও শক্তি প্রয়োগের সমন্বয়ে গঠিত এক নিখুঁত শিল্প। আজকের দিনে এই শৈলী বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তা আরও বিকশিত হচ্ছে। গ্রেকো-রোমান রেসলিং MMA ও অন্যান্য মার্শাল আর্টসে শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
ফ্রি স্টাইল রেসলিং (Freestyle Wrestling):
ফ্রি স্টাইল রেসলিং হলো একটি আধুনিক ও অলিম্পিক স্বীকৃত মল্লযুদ্ধভিত্তিক মার্শাল আর্ট, যেখানে প্রতিযোগীরা শরীরের যেকোনো অঙ্গ ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তবে পায়ের ব্যবহারই এই স্টাইলে মূখ্য। এই শৈলীতে প্রতিপক্ষকে মাটিতে আছড়ে ফেলা, পিন করা ও গ্র্যাপলিংয়ের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল শেখানো হয়। অন্যান্য রেসলিং ঘরানার তুলনায় এটি অনেক বেশি উন্মুক্ত, গতিশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে দ্রুত প্রতিক্রিয়া, টেকনিক্যাল দক্ষতা এবং শারীরিক সক্ষমতার নিখুঁত সমন্বয় দেখা যায়। ফ্রি স্টাইল রেসলিংয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর নিয়মের সিথিলতা এবং গতি, যেখানে প্রতিপক্ষের পা ধরেও আক্রমণ করা যায়, যা গ্রেকো-রোমান রেসলিংয়ের থেকে এটিকে আলাদা করে। ফ্রি স্টাইল রেসলিংয়ে মূল লক্ষ্য হলো দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং পয়েন্ট সংগ্রহ করা। এই শৈলীতে দক্ষতা, গতিশীলতা, শারীরিক সক্ষমতা ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে এখানে টেকডাউন, রিভার্সাল, গ্র্যাপলিং, পিন এবং সাবলীল গতিতে নানা রকম দৃষ্টিনন্দন কৌশল প্রয়োগ করা হয়। ফ্রি স্টাইল রেসলিং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এবং এটি বহু দেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও ক্রীড়াবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক প্রশিক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক মার্শাল আর্ট ও মিশ্র মার্শাল আর্টসের (MMA) ক্ষেত্রেও ফ্রি স্টাইল রেসলিংয়ের দক্ষতা অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়।
ক্যাচ রেসলিং (Catch Wrestling):
ক্যাচ রেসলিং হলো একটি ঐতিহ্যবাহী গ্র্যাপলিং ভিত্তিক মার্শাল আর্ট, যা ১৯শ শতকের ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে উদ্ভূত হয়। “ক্যাচ” শব্দটি এসেছে “Catch as Catch Can” অর্থাৎ “যেভাবে পারো সেভাবেই ধরো”, যা নির্দেশ করে এই শৈলীর কৌশলগুলোর নমনীয়তা ও স্বাধীনতা। ক্যাচ রেসলিংয়ের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন ধরণের লক, চোক, জয়েন্ট ম্যানিপুলেশন ও সাবমিশন টেকনিক ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ বা পরাস্ত করা। এটি রেসলিং ও সাবমিশন আর্টসের মাঝে একটি সেতুবন্ধন হিসাবে বিবেচিত হয়। ক্যাচ রেসলিংয়ে হাতাহাতি থেকে শুরু করে মাটির ওপর নির্ভর করে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল শেখানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট, রিভার্সাল, টেকডাউন, সাবমিশন হোল্ড ও জয়েন্ট লক। এই শৈলী ১৯শ শতকের আমেরিকায় প্রফেশনাল রেসলিং ও আধুনিক মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA) এর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ক্যাচ রেসলিং এর কৌশলগুলি MMA তে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে গ্র্যাপলিং ও সাবমিশন ফাইটিং অংশে। এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত মার্শাল আর্ট যা শরীরের লচিলা দক্ষতা, কৌশলগত চিন্তা ও ধৈর্য গড়ে তোলে।
মঙ্গোলিয়ান রেসলিং (Mongolian Wrestling):
মঙ্গোলিয়ান রেসলিং, যা মঙ্গোলিয়ান ভাষায় "বোখ" (Bökh) নামে পরিচিত, মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে পুরাতন ও জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট, যা দেশটির জাতীয় ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘বোখ’ শব্দের অর্থ “শক্তিশালীভাবে ধরা” বা “লড়াই”। এটি মূলত একটি গ্র্যাপলিং ভিত্তিক মার্শাল আর্ট, যেখানে দুই প্রতিযোগী একে অপরকে ধরাশায়ী করার জন্য শারীরিক শক্তি, কৌশল ও দক্ষতা ব্যবহার করে। মঙ্গোলিয়ান রেসলিংয়ের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো, যা মঙ্গোলিয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ ও জনগণের দৈনন্দিন জীবন থেকে উদ্ভূত। এই খেলায় প্রতিযোগীরা বিশেষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে, যা শরীরের অংশ বিশেষকে মুক্ত রেখে চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়। খেলাটি খুবই কড়া নিয়মাবলীর অধীনে চলে, যেখানে মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে দেওয়া, যাতে তার হাঁটু বা শরীরের কোনো অংশ মাটিতে স্পর্শ করে। শারীরিক বল প্রয়োগের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও স্টামিনা এই খেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গোলিয়ান রেসলিং মঙ্গোলিয়ানদের আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য এবং সম্মানের প্রতীক। প্রতি বছর মঙ্গোলিয়ার নঈওরজ উৎসবসহ বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এই খেলা আয়োজন করা হয়, যা হাজারো দর্শককে আকৃষ্ট করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মঙ্গোলিয়ান রেসলিং আজ বিশ্ব মার্শাল আর্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে এবং অনেক বিদেশী মার্শাল আর্টপ্রেমী মঙ্গোলিয়ায় এসে এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।
৩. অস্ত্রভিত্তিক মার্শাল আর্টস
অস্ত্রভিত্তিক মার্শাল আর্টস হলো এমন এক শৈলী যেখানে প্রধানত তলোয়ার, ছুরি, লাঠি, ঝাড়ু বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আত্মরক্ষা এবং যুদ্ধ কৌশল শেখানো হয়। এই ধরনের মার্শাল আর্টগুলি প্রাচীন সময় থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও দেশজুড়ে অস্ত্র পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গড়ে আধুনিক মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণে অস্ত্র পরিচালনার শিক্ষা আজও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাস্তব জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত থেকে বাঁচতে দক্ষতা প্রয়োজন। এই শৈলী শিখতে ধৈর্য, মনোযোগ এবং উচ্চমাত্রার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, যা একজন যোদ্ধাকে কৌশলী ও সাবলীল করে তোলে। অস্ত্রভিত্তিক মার্শাল আর্টস-এর প্রধান জনপ্রিয় স্টাইলগুলি হলো:
ফিলিপিনো মার্শাল আর্টস (Filipino Martial Arts বা FMA):
ফিলিপিনো মার্শাল আর্টস হলো মূলত অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধশৈলীর একটি ধারা। এর তিনটি প্রধান ধারা হলো: কালী (Kali), এসক্রিমা (Eskrima) ও আরনি (Arnis)। এই স্টাইলে ছুরি, লং স্টিক, শর্ট স্টিক এবং অন্যান্য ছোট অস্ত্র ব্যবহারে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করানো হয়। পাশাপাশি খালি হাতে আত্মরক্ষা, গ্র্যাপলিং এবং ক্লোজ-রেঞ্জ কনফ্রন্টেশনের কৌশলও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এতে রিফ্লেক্স, প্রতিক্রিয়া এবং অভিযোজন ক্ষমতার ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আজকের বিশ্বে FMA তার ব্যবহারিক দক্ষতা, অভিযোজনযোগ্যতা এবং গতিশীল প্রশিক্ষণ পদ্ধতির জন্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে এর বাস্তব ভিত্তিক কৌশলগুলো অনেকের কাছে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA)-এর মতো আধুনিক যুদ্ধশৈলীতেও FMA-এর বিভিন্ন কৌশল ও নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার পাশাপাশি মনোসংযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দেহ-মনের পারস্পরিক ভারসাম্যের একটি পরিপূর্ণ অনুশীলন।
কেনজুতসু (Kenjutsu):
কেনজুতসু হলো জাপানি ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট, যা মূলত তলোয়ার চালনার (সামুরাই তলোয়ার: কাতানা) ওপর ভিত্তি করে গঠিত। “কেনজুতসু” শব্দের অর্থ “তলোয়ারের কৌশল” বা “তলোয়ারের শিল্প” এবং এটি জাপানি সামন্তযুগের বিখ্যাত সামুরাই যোদ্ধাদের প্রধান যুদ্ধশৈলী ছিল। এই শৈলীতে একজন যোদ্ধাকে শুধু কৌশলীভাবে তলোয়ার চালানো, নির্ভুল সময় নির্বাচন, প্রতিপক্ষের গতিবিধি পড়া, মানসিক স্থিরতা ও প্রাণঘাতী আঘাত দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করানো হয়। মূলত, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য তৈরি করা এই মার্শাল আর্টে মারাত্মক ও বাস্তবিক আক্রমণ-পদ্ধতি শেখানো হতো, যা জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হতো। আজকের দিনে কেনজুতসু অনেকটাই ঐতিহাসিক ও ধ্যাননির্ভর মার্শাল আর্টে পরিণত হয়েছে, তবে এটি এখনও জাপানে ও অন্যান্য দেশে ঐতিহ্যবাহী কোরু বুয়ু (Koryu Bujutsu) শৈলীর অংশ হিসেবে চর্চা করা হয়। অনেক স্কুল বা ডোজোতে কেনজুতসুর বিভিন্ন রিউ (বিদ্যালয়) অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ফর্ম, কাতা (চালনা পদ্ধতি), স্টান্স (অবস্থান) এবং আত্মরক্ষামূলক কৌশল শেখানো হয়। কেনজুতসুকে আধুনিক কেনদো-এর ভিত্তি হিসেবে মনে করা হয়।
কেনদো (Kendo):
কেনদো একটি আধুনিক জাপানি মার্শাল আর্ট, যার মূল উদ্দেশ্য হলো তলোয়ার চালনার মাধ্যমে মানসিক, শারীরিক ও আত্মিক উন্নয়ন সাধন। “Kendo” শব্দের অর্থ “তলোয়ারের পথ” (Ken মানে তলোয়ার এবং Do মানে পথ)। এটি ঐতিহ্যবাহী কেনজুতসু থেকে উদ্ভূত হলেও, কেনদো একটি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত, প্রতিযোগিতামূলক ও ক্রীড়ানির্ভর যুদ্ধশৈলী হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক যুগে কেনদো মূলত বাঁশের তৈরি তলোয়ার শিনাই (Shinai) এবং প্রতিরক্ষা গিয়ার বোগু (Bogu) পরে অনুশীলন করা হয়, যেখানে প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট অংশে (মাথা, কাঁধ, কবজি ও বুক) আঘাত করার মাধ্যমে পয়েন্ট অর্জন করা হয়। কেনদো একটি দর্শন ও নৈতিক অনুশীলন যা আত্মনিয়ন্ত্রণ, সততা, সম্মান ও একাগ্রতার মতো গুণাবলি গঠনে সহায়তা করে। অনুশীলনকারীরা “কিয়া” (Kiai) নামক একধরনের আত্মবিশ্বাসী শব্দ ব্যবহার করে তাদের মানসিক শক্তি ও আক্রমণের দৃঢ়তা প্রকাশ করে। কেনদোতে বিজয় শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করাও একটি বড় লক্ষ্য। বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি মার্শাল আর্ট এবং বহু দেশে নিয়মিতভাবে টুর্নামেন্ট, গ্রেডিং এবং ডোজো প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়।
ইআইদো (Iaido):
ইআইদো হলো জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট, যা মূলত তলোয়ার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো তলোয়ার দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে চালনার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা। ইআইদো-এর উৎপত্তি ১৬শ শতকের জাপানে, যেখানে সামুরাই যোদ্ধারা দ্রুত প্রতিপক্ষের আকস্মিক আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এ কৌশল ব্যবহার করতেন। এই মার্শাল আর্টের মূল শিক্ষা হলো মনোযোগ, ধৈর্য এবং নিখুঁত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে তলোয়ার বের করে আক্রমণ করা এবং তার পরবর্তী নিয়ন্ত্রণ। ইআইদোতে বিশেষভাবে কাঠামোবদ্ধ “কাতা” (ফর্মাল মুভমেন্ট সিরিজ) চর্চা করা হয়, যা তলোয়ার আঁকার, আঘাত করার, প্রতিরোধ করার এবং তলোয়ার ঢাকনার (Saya) মধ্যে রেখে দেয়ার ধারাবাহিক কৌশলসমূহ অন্তর্ভুক্ত। এই অনুশীলন শুধুমাত্র শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে না, এটি মনের একাগ্রতা, শান্তি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের উন্নতিতেও সাহায্য করে। আধুনিক যুগে ইআইদো একটি দর্শন ও জীবনধারা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, যেখানে প্রশিক্ষণার্থী শৃঙ্খলা, সম্মান এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা পান। বিশ্বব্যাপী ইআইদোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে মার্শাল আর্ট প্রেমীদের মধ্যে, যারা প্রাচীন জাপানি সংস্কৃতি এবং তলোয়ার যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আগ্রহী।
কোবুদো (Kobudo):
কোবুদো হলো জাপানের একটি প্রাচীন অস্ত্রচালনা কেন্দ্রিক মার্শাল আর্ট, যা মূলত ওকিনাওয়া দ্বীপ থেকে উদ্ভূত। ‘কোবুদো’ শব্দের অর্থ “প্রাচীন যোদ্ধার পথ”। এই শৈলীটি ঐতিহাসিকভাবে কৃষক ও সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার জন্য বিকশিত হয়েছিল, যেখানে তারা সাধারণ কৃষিকাজের সরঞ্জামগুলো, যেমন- বোনগো, সাই, তনচু, চাকু ইত্যাদিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো। কোবুদোর মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের দক্ষ ব্যবহার, সঠিক ধরন ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা। এতে একক এবং দ্বৈত অস্ত্রের ব্যবহার, আত্মরক্ষা কৌশল এবং হাতাহাতির বিভিন্ন টেকনিক অন্তর্ভুক্ত আছে। কোবুদো প্রশিক্ষণে কাতা (ধাপে ধাপে অস্ত্র চর্চা) বিশেষ গুরুত্ব পায়, যা ধৈর্য, মনোযোগ ও নিখুঁত কৌশল অর্জনে সহায়তা করে। আধুনিক মার্শাল আর্টের অনুশীলনে কোবুদো এক ধরণের ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। কোবুদো শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখে। এটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মার্শাল আর্ট প্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বিশেষত যারা প্রাচীন অস্ত্রশৈলীর প্রতি আকৃষ্ট এবং এটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে।
ফেন্সিং (Fencing):
ফেন্সিং হলো ইউরোপীয় ঐতিহ্যবাহী এক মার্শাল আর্ট ও প্রতিযোগিতামূলক খেলা, যা মূলত হালকা তলোয়ার দিয়ে লড়াইয়ের কৌশল শিক্ষা দেয়। ফেন্সিংয়ের ইতিহাস বহু শতাব্দী আগের, যেখানে এটি প্রথমে বাস্তব যুদ্ধে তলোয়ালের দক্ষতা অর্জনের জন্য অনুশীলিত হতো। বর্তমানে এটি আধুনিক অলিম্পিক খেলাগুলোর অন্যতম তিনটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত: ফয়েল (Foil), ইপে (Epee) এবং স্যাবর (Sabre)। প্রতিটি বিভাগে আলাদা নিয়ম, লক্ষ্যবস্তু এবং আঘাতের ক্ষেত্র নির্ধারিত থাকে। ফেন্সিংয়ে গতি, সঠিক সময়ে প্রতিপক্ষের আঘাত এড়ানো ও নিখুঁত আঘাত দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক ফিটনেস, দ্রুত প্রতিক্রিয়া, মানসিক তীক্ষ্ণতা ও কৌশলগত চিন্তা ফেন্সিংয়ের মূল উপাদান। এটি এক ধরনের মস্তিষ্কের খেলা, যেখানে প্রতিপক্ষের চাল পড়া ও তার মোকাবেলায় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ফেন্সিং প্রশিক্ষণ মানসিক স্থিতিশীলতা, ধৈর্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। ফেন্সিং হলো মার্শাল আর্টস ও স্পোর্টসের এক অনন্য সমন্বয়, যা শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
ক্রাবি-ক্রাবং (Krabi-Krabong):
ক্রাবি-ক্রাবং থাইল্যান্ডের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট, যা প্রধানত অস্ত্রচালনা এবং হাতের কৌশলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। “ক্রাবি” বা তলোয়ার এবং “ক্রাবং” বা লাঠি, যা এই শৈলীর প্রধান অস্ত্রসমূহকে নির্দেশ করে। এই মার্শাল আর্টের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং আক্রমণাত্মক প্রতিরোধের মাধ্যমে লড়াই জয় করা। ক্রাবি-ক্রাবং-এর ইতিহাস প্রায় ৬০০ বছর পুরোনো, যা প্রাচীন সিয়াম (বর্তমান থাইল্যান্ড) সাম্রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতির অংশ ছিল। এই শৈলীতে তলোয়ার, লাঠি, ছুরি, ঢাল এবং অন্যান্য সহকারি অস্ত্রের দক্ষ ব্যবহার শেখানো হয়, সাথে সঙ্গে খালি হাতে লড়াই ও গ্র্যাপলিংয়ের কৌশলও অন্তর্ভুক্ত। ক্রাবি-ক্রাবং-এর অনুশীলনে শরীরের নমনীয়তা, দ্রুততা, সমন্বয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত এবং বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রচলিত রয়েছে। আধুনিক যুগে ক্রাবি-ক্রাবং তার ঐতিহ্য বজায় রেখে আধুনিক আত্মরক্ষা ও মার্শাল আর্ট চর্চায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী মার্শাল আর্ট প্রেমীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
৪. অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস (Internal Martial Arts)
অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস এমন একটি যুদ্ধশৈলী যেখানে বাহ্যিক পেশি শক্তির পরিবর্তে মানসিক নিয়ন্ত্রণ, শ্বাস-প্রশ্বাসের সুষম ব্যাবহার এবং আভ্যন্তরীণ শক্তি বা "চি" (Qi) চর্চার উপর জোর দেওয়া হয়। এটি মূলত আধ্যাত্মিক ও মেডিটেটিভ মার্শাল আর্ট। এই শৈলীগুলো ধীর, সচেতন গতিবিধি এবং গভীর মনোসংযোগের মাধ্যমে শরীর ও মনের সমন্বয় সাধন করে। মূলত আত্মরক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, মানসিক প্রশান্তি এবং শক্তি ভারসাম্য বৃদ্ধিতে এসব কৌশল ব্যবহৃত হয়। অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস চর্চাকারী একজন যোদ্ধা শুধু বাহ্যিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি নিজের ভেতরের শক্তিরও নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস-এর প্রধান জনপ্রিয় শৈলীগুলো হলো:
তাই চি (Tai Chi):
তাই চি মূলত "তাই চি ছুয়ান" নামে পরিচিত, একটি চীনা অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্ট যা ধীর ও মসৃণ গতিবিধির মাধ্যমে আত্মরক্ষা, মানসিক প্রশান্তি এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য অনুশীলন করা হয়। চীনের বিখ্যাত তিন অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস-এর মধ্যে তাই চি অন্যতম। এর মূল দর্শন দাঁড়িয়ে আছে “ইন” (Yin) ও “ইয়াং” (Yang)-এর সাম্য ও ভারসাম্যের ওপর, যা চীনা দর্শনের এক গভীর ভিত্তি। তাই চি-এর অনুশীলনে ধীরে ধীরে সঞ্চালিত পজিশন এবং গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরীণ শক্তি বা "চি" (Qi) জাগ্রত ও প্রবাহিত হয়। এটি প্রথমে আত্মরক্ষা কৌশল হিসেবে গঠিত হলেও সময়ের সাথে সাথে এটি সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর জন্য চর্চিত এক যোগব্যায়ামে রূপ নিয়েছে। বয়স্ক, দুর্বল বা অসুস্থ ব্যক্তিরাও এর চর্চা করতে পারেন, কারণ এতে তীব্রতা কম হলেও কার্যকারিতা অনেক বেশি। এটি শুধু শরীরকে নমনীয় করে, মানসিক চাপ কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মনোযোগ বাড়ায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তাই চি-এর উপকারিতা স্বীকৃত হয়েছে- বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ এবং মানসিক উদ্বেগ হ্রাসে এর ভূমিকা অনন্য।
বাগুয়াঝাং (Baguazhang):
বাগুয়াঝাং হলো একটি প্রাচীন চীনা অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্ট, যা তার গোলাকৃতি চলাফেরা, দ্রুত পদক্ষেপ ও ঘূর্ণায়মান শরীরচালনার জন্য বিখ্যাত। বাগুয়াঝাং-এর আধুনিক রূপ দেন দোং হাই ছুয়ান নামক এক মার্শাল আর্ট মাস্টার, যিনি ১৯ শতকে এই শৈলীর প্রচার করেন। চীনের বিখ্যাত তিন অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস-এর মধ্যে বাগুয়াঝাং একটি ধরা হয়। বাগুয়াঝাং নামের অর্থ “আট ত্রিকোণ হস্তচালনা”, যা তাওবাদী দর্শনের ই চিং (I Ching)-এর “বাগুয়া” তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। বাগুয়াঝাং-এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো ক্রমাগত গতিশীলতা, যেখানে চক্রাকারে হাঁটাহাঁটি বা “সার্কল ওয়াকিং” পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের শক্তি এবং ভারসাম্য অনুশীলন করা হয়। এই পদ্ধতিতে যোদ্ধা প্রতিপক্ষকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে সুযোগের অপেক্ষা করে এবং প্রতিক্রিয়া দেয় ফ্লুয়িড, এলাস্টিক এবং অপ্রত্যাশিত কৌশলে। এতে প্রচুর টুইস্ট, টার্ন, হাতের খোলা আকারে আঘাত, কবজি এবং কনুইয়ের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যা প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে এবং বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে। এতে “চি” (Qi) প্রবাহের উপরে জোর দেওয়া হয়, যার ফলে এটি ধ্যান, স্বাস্থ্য রক্ষা এবং আত্মরক্ষা- তিনটি উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাগুয়াঝাং সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যারা মার্শাল আর্টের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন খোঁজেন, তাদের কাছে এটি এক অতুলনীয় অনুশীলন।
জিং ই চুয়ান (Xing Yi Quan):
চীনের বিখ্যাত তিন অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টস-এর মধ্যে অন্যতম হলো জিং ই চুয়ান। এটি হসিন লু (Hsing-I) নামেও পরিচিত। জিং ই চুয়ান হলো চীনের অন্যতম প্রাচীন ও শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্ট, যা সরলরৈখিক গতি, বিস্ফোরণধর্মী শক্তি (Fa Jin) এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি “চি”-এর নিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। “জিং” মানে “আকার” বা “রূপ”, “ই” মানে “ইচ্ছাশক্তি” বা “মনোভাব”, আর “চুয়ান” মানে “মুষ্টিযুদ্ধ” বা “ঘুষির কৌশল”। এই শৈলীর মূল দর্শন হলো- মন যা কল্পনা করে, শরীর তাই অনুসরণ করে, অর্থাৎ মানসিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শারীরিক কৌশল প্রয়োগ। জিং ই চুয়ান-এর অনুশীলন সাধারণত পঞ্চ মৌলিক মুষ্টিকৌশল বা “ফাইভ এলিমেন্ট ফিস্টস” (Pi, Zuan, Beng, Pao এবং Heng) দিয়ে শুরু হয়, যা প্রাকৃতিক উপাদানের (ধাতু, পানি, কাঠ, আগুন, মাটি) প্রতীক এবং প্রতিটিই একটি নির্দিষ্ট অ্যাটাক বা ডিফেন্স মুভমেন্ট প্রকাশ করে। পাশাপাশি, এতে বারোটি প্রাণীর কৌশলও রয়েছে, যেমন- ড্রাগন, টাইগার, সাপ, ঘোড়া, ঈগল ইত্যাদি। এই শৈলী ধীর গতির থেকে অনেকটা ব্যতিক্রম- এর গতি দ্রুত, আঘাত সরল এবং প্রত্যক্ষ, তাই প্রতিপক্ষকে দ্রুত কাবু করে ফেলার লক্ষ্যে এটি ব্যবহার করা হয়। জিং ই চুয়ান একইসাথে স্বাস্থ্যরক্ষা ও আত্মরক্ষার একটি শৈলী। এটি দেহে অভ্যন্তরীণ শক্তি জাগিয়ে তোলে, শরীর ও মনের একত্রীকরণ ঘটায় এবং আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য বাড়াতে সহায়তা করে। তাই চি ও বাগুয়াঝাং-এর মতোই এটি অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টসের একটি অন্যতম স্তম্ভ, যা ধ্যান, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাস ও আত্মজাগরণের মাধ্যমে যোদ্ধার মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইয়ি চুয়ান (Yi Quan):
ইয়ি চুয়ান, যাকে "ইচ্ছাশক্তির মুষ্টি" বা "Mind Boxing" নামেও অভিহিত করা হয়, একটি আধুনিক চীনা অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্ট, যার মূল দর্শন মন ও দেহের সংযুক্তিতে যুদ্ধশৈলীর বিকাশ। ২০ শতকের শুরুতে চীনের খ্যাতিমান মার্শাল আর্ট সাধক ওয়াং শিয়াংঝাই ইয়ি চুয়ানের সূচনা করেন। এই শৈলী জিং ই চুয়ান থেকে বিকশিত, তবে, ইয়ি চুয়ানের কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম বা কাতার নিয়ম নেই। এখানে মনোযোগ দেওয়া হয় স্ট্রাকচার, কল্পনা-ভিত্তিক অনুশীলন, স্ট্যান্ডিং মেডিটেশন এবং অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশে। যুদ্ধের সময় শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, মনোযোগ এবং অভ্যন্তরীণ শক্তিকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা এই শৈলীর মূল উদ্দেশ্য। এতে স্ট্রাইকিং, পুশিং এবং মাইন্ড-ইন্টেনশন বেসড ফুটওয়ার্কের সমন্বয়ে আত্মরক্ষা, শক্তি এবং মানসিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা হয়। ইয়ি চুয়ান এক ধরনের মনঃসংযোগভিত্তিক জীবনচর্চা- যা চীনা দর্শন, মেডিটেটিভ থেরাপি এবং বাস্তব যুদ্ধকৌশলকে একীভূত করে তোলে।
লিউ হে ছুয়ান (Liu He Quan):
লিউ হে ছুয়ান হলো একটি প্রাচীন চীনা মার্শাল আর্ট, যার নামের অর্থ “ছয়টি সমন্বিত পথের মুষ্টি” বা “Six Harmonies Fist।” এই শৈলীর মূল ভিত্তি হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ- হাত, পা, মাথা ও চোখ এবং মানসিক ও শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় স্থাপন। লিউ হে ছুয়ান ধীরে ধীরে প্রাণবন্ত ও নমনীয় গতিতে সম্পন্ন হয়, যা অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রবাহ বৃদ্ধি করে। এই মার্শাল আর্টটি বাগুয়াঝাং ও তাই চি চুয়ানের মত অভ্যন্তরীণ মার্শাল আর্টের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে “ছয়টি সমন্বয়” হলো: শরীর ও মন, হাত ও পা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি, চিন্তা এবং শ্বাস, কৌশল ও গতি এবং আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা। লিউ হে ছুয়ান-এ ঘূর্ণায়মান ও বৃত্তাকার মুভমেন্টের পাশাপাশি সরল রেখার আন্দোলনও থাকে, যা প্রতিপক্ষের আঘাতকে এড়িয়ে দ্রুত ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি আত্মরক্ষা ও শারীরিক-মানসিক প্রশিক্ষণের সমন্বয়, যেখানে ধ্যান ও শারীরিক কৌশল একই সঙ্গে উন্নত হয়। ঐতিহাসিকভাবে, লিউ হে ছুয়ান চীনা মার্শাল আর্টের “অভ্যন্তরীণ” শাখার অন্যতম, যা যোদ্ধাদের দেহ ও মনকে সুরক্ষিত ও কার্যকর রাখে এবং শক্তির সুষম প্রবাহ বজায় রাখে। আজও এটি মার্শাল আর্ট অনুরাগী ও গবেষকদের মধ্যে সমাদৃত একটি শৈলী।
হো রাং ডো (Hwa Rang Do):
হো রাং ডো হলো কোরিয়ার এক প্রাচীন এবং ব্যাপক মার্শাল আর্ট শৈলী, যা কোরীয় ইতিহাসের প্রাচীন যোদ্ধা দল ‘হো রাং’-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই শৈলীটি শারীরিক লড়াই, অস্ত্রচালনা, আত্মরক্ষা এবং মানসিক প্রশিক্ষণের এক সমন্বিত সিস্টেম, যা কোরিয়ার প্রাচীন যুদ্ধকলার ঐতিহ্য ও দর্শনকে আধুনিক যুগের চাহিদা অনুযায়ী পুনর্গঠিত করেছে। হো রাং ডো তে কিকিং, পাঞ্চিং, গ্র্যাপলিং, ভূমি লড়াই, ছুরি ও অন্যান্য অস্ত্রচালনার বিভিন্ন কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকে। এছাড়া, এই শৈলীতে ধ্যান, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ এবং আত্মসংযমের মতো মানসিক প্রশিক্ষণেও গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা প্রশিক্ষণার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হো রাং ডো-এর মূল লক্ষ্য হলো দক্ষ আত্মরক্ষা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত চরিত্র গঠন। এই শৈলী বিশেষভাবে সেলফ-ডিফেন্স, ফিজিক্যাল ফিটনেস এবং মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধির জন্য আদর্শ। আধুনিক সময়ে হো রাং ডো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট কমিউনিটিতে স্বীকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ মার্শাল আর্ট সিস্টেম হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. হাইব্রিড মার্শাল আর্ট
হাইব্রিড মার্শাল আর্ট এমন একটি যুদ্ধশৈলী যেখানে বিভিন্ন ধরণের মার্শাল আর্টস, যেমন- স্ট্রাইকিং ও গ্র্যাপলিং মার্শাল আর্টের কার্যকর কৌশলগুলো একত্রিত করা হয়। এটি কোনো নির্দিষ্ট শৈলীতে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব আত্মরক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ের উপযোগীভাবে গঠিত হয়। এই ধরণের শৈলী যোদ্ধাকে সকল পরিস্থিতিতে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা প্রদান করে। হাইব্রিড মার্শাল আর্টস-এর প্রধান জনপ্রিয় স্টাইলগুলি হলো:
মিশ্র মার্শাল আর্টস (Mixed Martial Arts বা MMA):
MMA হলো আধুনিক যুগের অন্যতম বহুমাত্রিক ও বাস্তবমুখী যুদ্ধশৈলী, যা বিভিন্ন মার্শাল আর্ট ফর্মের কার্যকর কৌশল একত্রিত করে গঠিত হয়েছে। এতে স্ট্রাইকিং (ঘুষি-লাথি), গ্র্যাপলিং (ধরাধরি ও ফেলার কৌশল), সাবমিশন (বন্ধন বা আত্মসমর্পণ কৌশল), ইত্যাদির সমন্বয় ঘটে। MMA-র প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি নির্দিষ্ট কোনো এক শৈলীর মধ্যে আবদ্ধ নয়, এটি কারাতে, কুংফু, জুডো, জিউ-জিৎসু, মুই থাই, কিকবক্সিং, বক্সিং, রেসলিং ইত্যাদির শক্তিশালী দিকগুলো একত্র করে একটি পরিপূর্ণ ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করে। এতে একজন যোদ্ধা চাইলে স্ট্যান্ড-আপ ফাইট, গ্রাউন্ড ফাইট কিংবা ক্লিন্চ ফাইট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। বর্তমানে UFC (Ultimate Fighting Championship)-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে MMA মার্শাল আর্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ হিসেবে স্থান পেয়েছে। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা, পাশাপাশি বাস্তবজীবনের আত্মরক্ষা, ফিটনেস, মানসিক দৃঢ়তা এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিযোগিতা, শারীরিক সক্ষমতা এবং বাস্তব যুদ্ধের মতো অনুভূতির কারণে। তাই MMA হলো একবিংশ শতাব্দীর মার্শাল আর্টসের নতুন সংজ্ঞা, যেখানে কোনো নিয়ম বা রীতির গণ্ডিতে আটকে না থেকে একজন যোদ্ধা নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে পারে।
জিৎ কুন দো (Jeet Kune Do):
জিৎ কুন দো ব্রুস লি উদ্ভাবিত একটি আধুনিক আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধশৈলী, যা সরলতা, সরাসরি কৌশল এবং বাস্তবিক কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। 'Jeet Kune Do' শব্দগুচ্ছের অর্থ “আক্রমণ প্রতিহতো করার মুষ্টির পথ,” যার মূল দর্শন হলো প্রতিপক্ষের আঘাত থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানানো। ব্রুস লি প্রচলিত মার্শাল আর্টগুলোর অনুশাসন ও কঠোর কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন শৈলীর কার্যকর দিকগুলো, যেমন- বক্সিং, ফেন্সিং, কারাতে, জুডো এবং জিউ-জিৎসু একত্রিত করে এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেন, যা পরিস্থিতিভিত্তিক এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য। জিৎ কুন দোতে জটিল পদ্ধতি ও অবাস্তব গতি নেই, বরং স্বাভাবিক শরীরের গতির সাথে মিল রেখে প্রতিপক্ষকে দ্রুত এবং শক্তিশালীভাবে পরাজিত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এই কৌশল নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সব ধরনের কার্যকর কৌশল গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেয়। জিৎ কুন দো অনুশীলনকারী মনোবল, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উচ্চ মানসিক সতর্কতা অর্জন করে, যা যেকোনো ধরনের লড়াই বা বিপদময় পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য অপরিহার্য।
উশু (Wushu):
উশু হলো চীনের আধুনিক মার্শাল আর্ট, যা দ্রুতগতির স্ট্রাইকিং, লাথি, ঝাঁপ, ব্লক এবং বিভিন্ন প্রকার ফর্ম বা কাতা অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মরক্ষা ও লড়াইয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। উশু শব্দের অর্থ হলো “যুদ্ধশিল্প” বা “মার্শাল আর্ট” এবং এটি মূলত চীনের ঐতিহ্যবাহী কুংফুর আধুনিকীকৃত রূপ। উশুতে দুই প্রধান শাখা রয়েছে, তাওলু (Taolu)- বিভিন্ন কাতা ও ফর্মের মাধ্যমে শরীরের নমনীয়তা ও কৌশল দেখানো হয় এবং সন্দা (Sanda)- এটি একটি স্পোর্টস ফাইটিং স্টাইল, যেখানে স্ট্রাইকিং ও গ্র্যাপলিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা হয়। উশুর অনুশীলন শারীরিক শক্তি ও নমনীয়তা বৃদ্ধি, মানসিক একাগ্রতা, ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকাশে সহায়ক। আধুনিক সময়ের উশু বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মার্শাল আর্ট প্রেমীদের কাছে সমাদৃত। উশু-এর চর্চা করে অনুশীলনকারী কেবল যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী হয় না, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও সঠিক শারীরিক গঠনের সঙ্গেও পরিচিত হয়।
কাভ মাগা (Krav Maga):
কাভ মাগা একটি বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর আত্মরক্ষা শৈলী, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) প্রথম বিকাশ করে। হিব্রু ভাষায় “Krav Maga” অর্থ “যোগাযোগমূলক লড়াই” বা “ঘনিষ্ঠ যুদ্ধ”। এটি কোনো খেলাধুলাভিত্তিক মার্শাল আর্ট নয়, জীবন-মরণ পরিস্থিতিতে দ্রুত, কার্যকর ও নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই শৈলীতে প্রতিপক্ষকে দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা, অস্ত্রধারীর আক্রমণ প্রতিহতো করা, একাধিক আক্রমণকারীর মুখোমুখি হওয়া এবং ভয় ও মানসিক চাপের মধ্যেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কাভ মাগা-তে ঘুষি, লাথি, কনুই, হাঁটু, গ্র্যাপলিং, ডিসআর্মিং এবং শরীরের দুর্বল পয়েন্টে আক্রমণের কৌশলগুলো শেখানো হয়। এটি জুডো, বক্সিং, কারাতে, মুই থাই এবং রেসলিংয়ের বিভিন্ন কার্যকর দিকগুলোকে একত্রিত করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি শেখায় কিভাবে সংঘাত এড়ানো যায় এবং প্রয়োজন হলে সবচেয়ে কম সময়ে কিভাবে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করা যায়। সামরিক, পুলিশ এবং বেসামরিক মানুষদের জন্য এটি সমানভাবে উপযোগী। আধুনিক বিশ্বের শহুরে আত্মরক্ষার জন্য কাভ মাগা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ভয়ানক কার্যকর মার্শাল আর্ট।
কারাতে-জিউ-জিৎসু (Karate-Jujitsu):
কারাতে-জিউ-জিৎসু একটি হাইব্রিড মার্শাল আর্ট ফর্ম যা স্ট্রাইকিং ও গ্র্যাপলিং এই দুই ভিন্ন যুদ্ধশৈলীর কার্যকর কৌশলকে একত্রিত করে। এই শৈলীতে কারাতের সরল, শক্তিশালী ঘুষি, লাথি, ব্লক এবং স্টানিং অ্যাটাকের সঙ্গে জিউ-জিৎসুর গ্র্যাপলিং, সাবমিশন, জয়েন্ট লক, চোক এবং ফেলে দেওয়ার কৌশলগুলোর সমন্বয় থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে দূর থেকে আঘাত করার পাশাপাশি কাছে এলে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া বা মাটিতে ফেলে আত্মরক্ষা নিশ্চিত করা। কারাতে- জিউ-জিৎসু সিস্টেমটি আত্মরক্ষা, পুলিশি প্রশিক্ষণ ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ এটি বাস্তব পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য ডিজাইন করা। একজন অনুশীলনকারী শিখে কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আক্রমণ প্রতিহতো করতে হয়, আবার যদি প্রতিপক্ষ ধরে ফেলে বা মাটিতে ফেলে দেয়, তখন কিভাবে পাল্টা জবাব দিতে হয়। এতে কারাতের গতি ও শক্তি এবং জিউ-জিৎসুর নিয়ন্ত্রণ ও টেকনিকাল স্কিল, দুটিই একসঙ্গে বিকশিত হয়। এই হাইব্রিড শৈলী আধুনিক আত্মরক্ষা পদ্ধতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। কারাতে ও জিউ-জিৎসুর বিভিন্ন কৌশল মিশিয়ে গড়ে ওঠা শৈলী, যা আত্মরক্ষা ও প্রতিযোগিতায় সমান কার্যকর।
মুশিনকাইডো (Mushinkai-Do):
মুশিনকাইডো হলো একটি আধুনিক মার্শাল আর্ট শৈলী, যার নামের মধ্যেই এর দার্শনিক ভিত্তি নিহিত আছে- "মুশিন" অর্থাৎ 'নিঃসংকল্প মন' এবং "কাইডো" অর্থাৎ 'পথ' বা 'দর্শন'। মুশিনকাইডো মূলত জাপানি মার্শাল আর্টের বিভিন্ন উপাদান, যেমন- কারাতে, জুডো, আইকিডো এবং জুজিৎসু- এসবের মিশ্রণে গঠিত একটি হাইব্রিড শৈলী, যেখানে শরীরের শক্তি ও মানসিক শান্তির ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। এর মূল দর্শন হলো "মুশিন"- একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে যোদ্ধার মন থাকে ফাঁকা, স্থির এবং প্রতিক্রিয়ার জন্য সদা প্রস্তুত, যা যেকোনো আক্রমণ বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক। মুশিনকাইডো প্রশিক্ষণে স্ট্রাইকিং, থ্রো, সাবমিশন, আত্মরক্ষামূলক রিফ্লেক্স এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল শেখানো হয়। এটি শুধু শারীরিক দক্ষতার উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহনশীলতা, নম্রতা ও ধ্যান- এই সব মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলোকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। মুশিনকাইডো একজন অনুশীলনকারীকে শেখায় কিভাবে যোদ্ধা হয়েও একজন শান্তিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায়। আধুনিক যুগে এর প্রশিক্ষণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি এখন এক বৈশ্বিক মার্শাল আর্ট সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে, যেখানে আত্মরক্ষা, চরিত্র গঠন ও আত্মজ্ঞান- এই তিনটি দিক একসাথে চর্চা করা হয়। এটি যুদ্ধশৈলীর পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক শৃঙ্খলার অনুশীলন এবং এক ধরণের আত্মিক সাধনার পথ।
হাপকিডো (Hapkido):
হাপকিডো একটি কোরিয়ান হাইব্রিড মার্শাল আর্ট, যা আত্মরক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ কৌশলে অত্যন্ত কার্যকর এবং এর বৈচিত্র্যময় কৌশলের জন্য পরিচিত। "হাপ" মানে "সামঞ্জস্য", "কি" মানে "শক্তি বা অভ্যন্তরীণ শক্তি" এবং "ডো" মানে "পথ", অর্থাৎ হাপকিডো হচ্ছে “শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যের পথ”। এই শৈলীতে স্ট্রাইকিং (ঘুষি, লাথি), গ্র্যাপলিং, জয়েন্ট লক, থ্রো, ফেলা দেওয়া এবং নিরস্ত্রীকরণ কৌশল মিলেমিশে একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মরক্ষা পদ্ধতি তৈরি করে। হাপকিডোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিপক্ষের আক্রমণের শক্তিকে তার বিপরীতে ব্যবহার করা, অর্থাৎ 'রিডাইরেকশন' বা শক্তি ঘুরিয়ে দেওয়া। এটি একদিকে যেমন মৃদু এবং নমনীয় আন্দোলনের ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে আক্রমণাত্মক ও নির্ভুল প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। হাপকিডোতে সাধারণত লো-কিক, ফাস্ট পাঞ্চ, স্পিন কিকের মতো স্ট্রাইকিং কৌশল এবং অ্যাকুরেট জয়েন্ট ম্যানিপুলেশন ও প্রেসার পয়েন্ট কন্ট্রোল ব্যবহৃত হয়। এটি কোরিয়ান পুলিশ ও মিলিটারি ট্রেনিং প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত এবং আত্মরক্ষার পাশাপাশি মানসিক নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। হাপকিডো আধুনিক যুগের জন্য একটি ব্যালান্সড মার্শাল আর্টস সিস্টেম।
শোতোকাইডো (Shootfighting):
শোতোকাইডো হলো একটি আধুনিক ফাইটিং সিস্টেম, যা স্ট্রাইকিং এবং গ্র্যাপলিং উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এটি মূলত ১৯৯০-এর দশকে জাপানে বিকশিত হয় এবং আধুনিক মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA) এর প্রাথমিক রূপ হিসেবে বিবেচিত। শোতোকাইডো এর নাম এসেছে “শুট” (Shoot), যা বাস্তব বা নিয়মিত লড়াইয়ের প্রতীক এবং “ফাইটিং” অর্থ লড়াই। এই শৈলী মূলত কাজুয়ো মিসাকি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, যিনি বিভিন্ন মার্শাল আর্ট, যেমন- কারাতে, জুডো, মুশিনকাইডো, গ্র্যাপলিং ইত্যাদি থেকে কার্যকর কৌশলগুলো একত্রিত করেন। শোতোকাইডোতে স্ট্রাইকিং, যেমন- ঘুষি, লাথি, কনুই, হাঁটু এবং গ্র্যাপলিং, যেমন- ক্লিঞ্চ, টেকডাউন, সাবমিশন হোল্ড ব্যবহার করা হয়। এই মার্শাল আর্টে শারীরিক ফিটনেস, দ্রুত প্রতিক্রিয়া, কৌশলগত চিন্তা এবং মানসিক দৃঢ়তার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি বিশেষত রিং বা কেজে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয় এবং বিশ্বজুড়ে বহু ফাইটার ও প্রশিক্ষক এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শোতোকাইডো আধুনিক সময়ের মার্শাল আর্টসের মধ্যে একটি সুষম ও কার্যকর পদ্ধতি, যা যেকোনো রকমের লড়াই পরিস্থিতিতে দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে।
সন্দা (Sanda):
সন্দা চাইনিজ বক্সিং বা চীন মার্শাল আর্টসের আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক রূপ হিসেবে পরিচিত, একটি পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকিং ও গ্র্যাপলিং মার্শাল আর্ট। এটি মূলত চীনা সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে উদ্ভূত এবং আধুনিক সময়ের জন্য অ্যান্টি-ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে ঘুষি, লাথি, কনুই, হাঁটু ব্যবহার ছাড়াও টেকডাউন, ক্লিঞ্চ ও কড়া গ্র্যাপলিং কৌশল অন্তর্ভুক্ত। সন্দার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ভারসাম্যপূর্ণ যুদ্ধশৈলী, যা প্রতিপক্ষকে দূর থেকে আঘাত করার পাশাপাশি কাছে এলে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সক্ষমতা প্রদান করে। সন্দার লড়াই সাধারণত একটি প্ল্যাটফর্ম বা রিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রতিযোগীরা বিভিন্ন স্ট্রাইক ও গ্র্যাপলিং টেকনিক দিয়ে পয়েন্ট অর্জন করে। এটি চীনা মার্শাল আর্টসের ঐতিহ্য এবং আধুনিক স্পোর্টস মার্শাল আর্টসের মেলবন্ধন, যা আজকের মিশ্র মার্শাল আর্টস (MMA) এর জন্যও একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সন্দা দ্রুততা, শক্তি, কৌশল এবং স্ট্যামিনা বৃদ্ধিতে কার্যকর, যা অনুশীলনকারীদের শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে প্রস্তুত করে তোলে। বর্তমানে সন্দা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক মার্শাল আর্টস বা আত্মরক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য।
পেনকাক সিলাট (Pencak Silat):
পেনকাক সিলাট হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ মার্শাল আর্ট, যা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বিকশিত হয়েছে। পেনকাক সিলাটে আত্মরক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক চর্চার একটি অনন্য সংমিশ্রণ রয়েছে। এই মার্শাল আর্টে স্ট্রাইকিং, গ্র্যাপলিং, লক, ফেলে দেওয়া এবং অস্ত্রচালনার বিভিন্ন কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকে। পেনকাক সিলাটের বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রাঞ্জল, নমনীয় এবং গতিশীল আন্দোলন, যা দ্রুত আক্রমণ এবং প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। পেনকাক সিলাট শিক্ষা ও চর্চায় নৃত্য ও প্রতিরক্ষামূলক কৌশলগুলোর এক অভিনব সমন্বয় দেখা যায়, যা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই করে তৈরি করা হয়েছে। এই মার্শাল আর্টে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে তলোয়ার, বর্শা, ছুরি, কাঠের লাঠি এবং অন্যান্য স্থানীয় অস্ত্র। আধুনিক সময়ে পেনকাক সিলাট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এটি অনেক দেশের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতেও প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ভোভিনাম (Vovinam):
ভোভিনাম হলো ভিয়েতনামের জাতীয় মার্শাল আর্ট, যা আধুনিক সময়ে আত্মরক্ষা এবং শারীরিক ও মানসিক উন্নতির উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে। এটি ১৯৩০-এর দশকে গুরু নুয়েন লোং নহ নামের একজন ভিয়েতনামী মার্শাল আর্ট মাস্টার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ভোভিনাম মার্শাল আর্টে স্ট্রাইকিং, কিকিং, গ্র্যাপলিং, থ্রো, সাবমিশন এবং অস্ত্রচালনার সমন্বয় রয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো শক্তি, নমনীয়তা, ভারসাম্য, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা এবং মানসিক শান্তি ও ধৈর্য্য বিকাশ করা। ভোভিনামে বিভিন্ন ধরণের আঘাতপ্রদান পদ্ধতি, যেমন- হাত, পা, কনুই, হাঁটু ব্যবহার করা হয় এবং এটি শত্রুকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল শেখায়। এছাড়া, এটি নিজেকে আত্মরক্ষার পাশাপাশি জীবনের বিভিন্ন কঠিন মুহূর্তে মানসিক দৃঢ়তা বজায় রাখতে শেখায়। ভোভিনামের অনুশীলনকারীরা শারীরিক ফিটনেস বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজের আত্মসম্মান ও নিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলে। আধুনিক মার্শাল আর্টের সঙ্গে মিল রেখে ভোভিনাম আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতাগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। এই মার্শাল আর্টে আত্মরক্ষা, শৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
কাপোইরা (Capoeira):
কাপোইরা হলো ব্রাজিলীয় এক অনন্য মার্শাল আর্ট শৈলী, যা যুদ্ধকলা, সঙ্গীত, নৃত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। এর উৎপত্তি হয়েছিল ১৬শ থেকে ১৯শ শতকের মধ্যে, ব্রাজিলে আফ্রিকা থেকে আনা দাসদের মধ্যে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে আত্মরক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জনের একটি গোপন অস্ত্র হিসেবেই কাপোইরার জন্ম। দাসেরা যাতে তাদের লড়াইয়ের কৌশল প্রকাশ্যে অনুশীলন করতে পারে, সেজন্য তারা এটি নাচ এবং বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে ছদ্মবেশে উপস্থাপন করত। সেই ঐতিহাসিক ব্যাকড্রপ আজও কাপোইরার প্রতিটি গতিবিধি, ছন্দ ও সংগীতে জড়িয়ে রয়েছে। এটি মূলত রিং বা "রোডা" নামক বৃত্তের মধ্যে পরিবেশিত হয়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা ছন্দে ছন্দে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। শারীরিক দিক থেকে কাপোইরা চরম ফ্লেক্সিবিলিটি, অ্যাক্রোবেটিক্স ও গতিশীলতার উপর জোর দেয়, যার ফলে এটি দেখতে অনেকটাই একটি নৃত্যকলা পরিবেশনার মতো মনে হয়, অথচ এর মধ্যে রয়েছে কার্যকর আত্মরক্ষার কৌশল। "বেরিমবাও" নামক ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র এবং গান ও হাততালির মাধ্যমে এই শৈলী একটি সংস্কৃতিমূলক অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়। আধুনিক বিশ্বে কাপোইরা ব্রাজিলের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং অনেক দেশেই এটি শরীরচর্চা, আত্মরক্ষা ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ইউনেস্কো ২০১৪ সালে কাপোইরাকে মানবতার অমূল্য সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্যানক্রেশন (Pankration):
প্যানক্রেশন ছিল প্রাচীন গ্রিসের একটি শক্তিশালী ও নৃশংস মার্শাল আর্ট শৈলী, যা ঘুষি, লাথি, ধাক্কাধাক্কি, গ্র্যাপলিং এবং সাবমিশন কৌশলের সমন্বয়ে গঠিত। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪৮ সালে এটি অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তখন থেকেই এটি গ্রিক যোদ্ধাদের মধ্যে আত্মরক্ষা ও যুদ্ধের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে। প্যানক্রেশনের নাম এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ থেকে 'Pan' (সব) এবং 'Kratos' (শক্তি বা ক্ষমতা), যার মানে দাঁড়ায় “সর্বশক্তির ব্যবহার।” এই শৈলীতে কিছু কৌশল নিষিদ্ধ, যেমন- চোখে আঘাত ও কামড়। এতে প্রতিযোগীরা শারীরিক দক্ষতা ছাড়াও ধৈর্য, কৌশল ও মানসিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করত। প্যানক্রেশনকে অনেকেই আধুনিক মিশ্র মার্শাল আর্ট এর পূর্বসূরি মনে করেন, কারণ এতে স্ট্রাইকিং এবং গ্রাউন্ড ফাইটিং উভয় দিকই গুরুত্ব সহকারে চর্চা করা হতো। আজকের দিনে, ইতিহাসবিদ ও মার্শাল আর্ট অনুরাগীদের মধ্যে এই শৈলীটি নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে এবং অনেক আধুনিক মার্শাল আর্ট স্কুল পুনর্গঠিত প্যানক্রেশনকে আবারও প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করছে।
কাজুকেনবো (Kajukenbo):
কাজুকেনবো হলো একটি আধুনিক মার্শাল আর্ট, যা ১৯৪০-এর দশকে হাওয়াইতে বিকাশ লাভ করে। এর নামটি এসেছে পাঁচটি মার্শাল আর্ট শৈলীর সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে কারাতে (Ka), জুডো ও জু-জিৎসু (Ju), কংফু (Ken) এবং বক্সিং (Bo)। কাজুকেনবো এর মূল লক্ষ্য হলো বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর আত্মরক্ষা কৌশল তৈরি করা, যা দ্রুত এবং সহজে প্রয়োগযোগ্য। এই শৈলীর মাধ্যমে বিভিন্ন মার্শাল আর্টের কৌশল একত্রিত করে একটি বহুমুখী লড়াই পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে। কাজুকেনবোতে স্ট্রাইকিং, কিকিং, গ্র্যাপলিং এবং সাবমিশন কৌশলগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা প্রশিক্ষণার্থীদের সব দিক থেকে প্রস্তুত করে তোলে। এই মার্শাল আর্টের বিশেষত্ব হলো এর নমনীয়তা ও অভিযোজনক্ষমতা, যা বিভিন্ন ধরণের প্রতিপক্ষ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কাজুকেনবো-তে শারীরিক শক্তি, দ্রুততা, কৌশলগত চিন্তা এবং মানসিক দৃঢ়তার সমন্বয় ঘটানো হয়। আধুনিক মার্শাল আর্ট ও সেলফ-ডিফেন্সের ক্ষেত্রে কাজুকেনবোকে একটি কার্যকর ও প্রমাণিত পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠছে এবং এটি মার্শাল আর্ট প্রেমীদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
নিনজুতসু (Ninjutsu):
নিনজুতসু হলো জাপানের ঐতিহাসিক ও গোপনীয় মার্শাল আর্ট, যা মূলত গুপ্তচরবৃত্তি, গোপন অভিযান এবং আত্মরক্ষার কৌশলগুলোর সংমিশ্রণ। এটি প্রাচীনকাল থেকে “নিঞ্জা” বা গুপ্তযোদ্ধাদের দ্বারা চর্চিত হতো, যারা যুদ্ধের মাঠে সরাসরি লড়াইয়ের পাশাপাশি গোপন অপারেশন, অবরোধ ভাঙা ও শত্রু নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। নিনজুতসু লড়াইয়ের কৌশলের পাশাপাশি ছদ্মবেশ, গোপন পথে চলাচল, সরঞ্জাম ব্যবহার, মনোযোগ ও মানসিক প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন দক্ষতার সমন্বয়। এই শৈলীতে বিভিন্ন অস্ত্র, যেমন- শুরিকেন (ছুরি), কাতানা (তলোয়ার), বোম্বা, লাঠি এবং হাতের কৌশল অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, দ্রুত পালানোর কৌশল, নিভৃতি ও গোপনতার অনুশীলনও এতে গুরুত্বপূর্ণ। নিনজুতসুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিপক্ষকে অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত করা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাকটিক্যাল সুবিধা অর্জন। আধুনিক সময়ে নিনজুতসু একটি সম্মানিত মার্শাল আর্ট হিসেবে বিকশিত হয়েছে।
সিসটেমা (Systema):
সিসটেমা হলো রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর দ্বারা বিকশিত একটি বহুমুখী ও ফ্লুয়িড মার্শাল আর্ট শৈলী, যা আত্মরক্ষা, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক স্থিরতার এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই শৈলীতে নির্দিষ্ট কোনো ফর্ম বা কাতার পরিবর্তে, পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে স্বাভাবিক ও মুক্ত গতিতে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা হয়। সিসটেমা মূলত তিনটি ভিত্তির ওপর গঠিত শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ, শরীরের কাঠামোগত সচেতনতা এবং রিল্যাক্সেশন। এতে হাতাহাতি, গ্র্যাপলিং, অস্ত্র প্রতিরোধ এবং স্নায়ুবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়া সমন্বিতভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রতিপক্ষের শক্তিকে প্রতিহতো না করে, বরং সেই শক্তির দিক পরিবর্তন করে নিরস্ত করা শেখায়। সিসটেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর প্রশিক্ষণ যুদ্ধক্ষেত্র বা বাস্তব জীবনের হুমকি মোকাবেলায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। সেনাবাহিনীর সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মী, এমনকি সাধারণ মানুষও আত্মরক্ষা, শরীর-মন নিয়ন্ত্রণ এবং স্ট্রেস ব্যবস্থাপনার জন্য এটি শিখে থাকেন। আধুনিক সময়ের অন্যতম কার্যকর ও অভিযোজনক্ষম মার্শাল আর্ট হিসেবে সিসটেমা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
মারিন কর্পস মার্শাল আর্টস প্রোগ্রাম (Marine Corps Martial Arts Program বা MCMAP):
MCMAP মার্কিন মেরিন কর্পসের তৈরি একটি আধুনিক যুদ্ধ-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, যা আত্মরক্ষা, অস্ত্র কৌশল, মনোবল ও নৈতিক আদর্শের সমন্বয়ে গঠিত। ২০০১ সালে চালু হওয়া এই প্রোগ্রামে ব্রাজিলিয়ান জিউ-জিৎসু, কারাতে, কিকবক্সিং, মুয়াই থাই, জুডো ও কালী থেকে কৌশল নিয়ে একটি সমন্বিত সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। এতে বেল্ট সিস্টেম রয়েছে, যা শারীরিক দক্ষতা ছাড়াও নেতৃত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলির ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়িত হয়। MCMAP একজন মেরিনকে যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার পাশাপাশি একজন ভারসাম্যপূর্ণ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলে।
মার্শাল আর্ট শেখার উপকারিতা
মার্শাল আর্টের উপকারিতা বহুমুখী- এটি শুধু আত্মরক্ষা শেখায় না, বরং শারীরিক ফিটনেস, মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি করে। এটি একটি জীবনদর্শন, যা ব্যক্তি হিসেবে আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শেখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি যেমন নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট ও সুরক্ষিত রাখতে পারে, তেমনি আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো গুণাবলিও অর্জন করতে পারে। মার্শাল আর্ট শিখলে কি কি সুবিধা পাওয়া যায় এবং এর উপকারিতা কি- তা নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্ট
মার্শাল আর্টের সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং তাৎক্ষণিক উপকারিতা হলো আত্মরক্ষা। অপ্রত্যাশিত বিপদ বা আক্রমণের মুখে নিজেকে এবং প্রিয়জনকে রক্ষা করার ক্ষমতা মার্শাল আর্টের মৌলিক শিক্ষা। এটি শারীরিক শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি পরিস্থিতি বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর দক্ষতাও শেখায়।
- বিপদ সচেতনতা: মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণার্থীদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকতে শেখায়। এটি অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি এড়ানো এবং আগাম বিপদ অনুমান করার ক্ষমতা বাড়ায়।
- পালানোর কৌশল: সব সময় প্রতিরোধের প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো পরিস্থিতি থেকে নিরাপদে সরে আসা। মার্শাল আর্ট দ্রুত এবং কার্যকরভাবে বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কৌশল শেখায়।
- কার্যকর প্রতিরোধ: যখন পালানো সম্ভব নয়, তখন আত্মরক্ষার জন্য কার্যকর প্রতিরোধ অপরিহার্য। মার্শাল আর্ট বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ, যেমন- ঘুষি, লাথি, ধরা বা ছুরিকাঘাতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কৌশল শেখায়। এর মধ্যে ব্লক, ডজ, পাল্টা আক্রমণ এবং নিয়ন্ত্রণ কৌশল অন্তর্ভুক্ত।
শারীরিক ফিটনেস
মার্শাল আর্ট একটি সম্পূর্ণ শারীরিক ওয়ার্কআউট হিসেবে কাজ করে, যা শরীরের প্রতিটি পেশীকে সক্রিয় করে তোলে। এর নিয়মিত অনুশীলন শারীরিক ফিটনেস এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
- হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য: মার্শাল আর্ট অনুশীলনে কার্ডিও ব্যায়াম সংঘটিত হয়, যাতে প্রচুর কার্ডিওভাসকুলার কার্যকলাপ জড়িত থাকে, যেমন- দ্রুত নড়াচড়া, লাফানো এবং বিভিন্ন কৌশল অনুশীলন। এটি হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য উন্নত করে, রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং স্ট্যামিনা বৃদ্ধি করে।
- শক্তি এবং সহনশীলতা: ঘুষি, লাথি এবং ধরার কৌশলগুলি অনুশীলন করতে শরীরের প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। এটি পেশী তৈরি করে এবং সার্বিক শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরের সহনশীলতাও বাড়ে, যার ফলে দীর্ঘক্ষণ শারীরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
- নমনীয়তা এবং ভারসাম্য: মার্শাল আর্টের অনেক কৌশলেই শরীরের নমনীয়তা এবং ভারসাম্যের প্রয়োজন হয়। স্ট্রেচিং এবং নির্দিষ্ট নড়াচড়ার অনুশীলন পেশী এবং জয়েন্টগুলোকে আরও নমনীয় করে তোলে, যা আঘাতের ঝুঁকি কমায় এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি করে। ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ভারসাম্যের উন্নতি শারীরিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়, যা দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: মার্শাল আর্ট একটি উচ্চ-তীব্রতার শারীরিক ব্যায়াম, যা ক্যালরি পোড়াতে এবং শরীরের মেদ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। নিয়মিত অনুশীলন শরীরের বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে এবং সুস্থ ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- শরীরের সমন্বয়: হাত-চোখের সমন্বয়, পায়ের কাজ এবং সামগ্রিক শরীরের সমন্বয় মার্শাল আর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনুশীলনের মাধ্যমে এই সমন্বয় দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়।
মানসিক শক্তি বৃদ্ধি
শারীরিক সুবিধার পাশাপাশি, মানসিক শক্তি বাড়াতে মার্শাল আর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কারণ এটি ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংকট মোকাবিলার মানসিক প্রস্তুতি গড়ে তোলে।
- শৃঙ্খলা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ: মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণে কঠোর শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা অপরিহার্য। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলা, প্রশিক্ষকের নির্দেশ পালন করা এবং নিয়মিত অনুশীলন করা মানসিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা রাগ, হতাশা বা ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়।
- মনোযোগ এবং একাগ্রতা: মার্শাল আর্টের কৌশলগুলি নির্ভুলভাবে অনুশীলন করার জন্য উচ্চ মাত্রার মনোযোগ এবং একাগ্রতার প্রয়োজন। প্রতিটি নড়াচড়া এবং কৌশলে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয়, যা মানসিক একাগ্রতা বাড়ায় এবং দৈনন্দিন জীবনেও যেকোনো কাজে ফোকাস করতে সাহায্য করে।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: শারীরিক কার্যকলাপ স্ট্রেস হরমোন কমাতে এবং এন্ডোরফিন নিঃসরণ করতে সাহায্য করে, যা প্রাকৃতিক মুড লিফটার হিসেবে কাজ করে। মানসিক চাপ কমাতে মার্শাল আর্ট অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এর অনুশীলন শরীরচর্চার মাধ্যমে স্ট্রেস হরমোন হ্রাস করে এবং মনকে শান্ত ও একাগ্র রাখতে সহায়তা করে। এটি মনকে শান্ত রাখে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
- লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অর্জন: মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণার্থীদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে এবং সেগুলো অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা করতে শেখায়। বেল্ট পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছোট ছোট লক্ষ্য অর্জন করার প্রক্রিয়া আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং অধ্যবসায় শেখায়।
- বিনয় এবং শ্রদ্ধা: মার্শাল আর্টের দর্শনে বিনয় এবং শ্রদ্ধার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। প্রশিক্ষক, সহকর্মী এবং প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মার্শাল আর্টের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ব্যক্তিগত অহংকার কমাতে এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখায়।
- আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান: মার্শাল আর্টের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে শেখে। প্রতিটি সফল অনুশীলন এবং লক্ষ্য অর্জন আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং আত্মসম্মানবোধ দৃঢ় করে। এই আত্মবিশ্বাস শুধু ডোজো (প্রশিক্ষণ স্থান) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- নৈতিকতা ও আত্ম-উন্নয়ন: অনেক মার্শাল আর্ট দর্শনের ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি, অহিংসা ও ন্যায়বোধের চর্চা করা হয়। এটি ব্যক্তিকে আত্মকেন্দ্রিক নয় বরং দায়িত্বশীল ও মানবিক করে গড়ে তোলে।
- শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ: প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী অনুশীলন, গুরুজনদের প্রতি সম্মান, সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস একজন শিক্ষার্থীকে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এই গুণাবলি শুধু মার্শাল আর্টেই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
- জীবনের জন্য প্রস্তুতি: মার্শাল আর্ট শুধু একটি শারীরিক অনুশীলন নয়, এটি জীবনবোধ। এটি শেখায় কীভাবে ব্যর্থতা গ্রহণ করতে হয়, কিভাবে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হয় এবং কীভাবে নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সফলতা অর্জন করতে হয়।
সব মিলিয়ে, মার্শাল আর্ট শেখা একজন ব্যক্তির জীবনকে বহুমাত্রিকভাবে সমৃদ্ধ করে। এটি একটি শক্তিশালী জীবনচর্চা, যা শরীর ও মনের ভারসাম্য রক্ষা করে, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে এবং ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সহায়তা করে। শিশুরা, কিশোর-কিশোরী, নারী, পুরুষ সবার জন্যই এটি এক কার্যকর, নিরাপদ ও অর্থবহ অনুশীলন।। সর্বোপরি, মার্শাল আর্ট লাইফস্টাইলকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
মার্শাল আর্ট শুধুমাত্র আত্মরক্ষার কৌশল বা ব্যায়ামই নয়, এটি আজ একটি বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক খেলার রূপ নিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে বহু দেশ, সংস্থা ও অলিম্পিক কমিটির স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বিভিন্ন মার্শাল আর্ট শৈলী, যেমন- কারাতে, তায়কোয়ান্দো, জুডো, কুংফু, মুয়ায় থাই, ব্রাজিলিয়ান জুজিৎসু ও মিক্সড মার্শাল আর্টস (MMA)- এই সবগুলোই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে। বিশেষত তায়কোয়ান্দো ও জুডো অলিম্পিক গেমসে স্বীকৃত মার্শাল আর্ট, যেখানে বহু দেশ দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (IOC) তত্ত্বাবধানে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। পাশাপাশি, WKF (World Karate Federation), WTF (World Taekwondo Federation), IBJJF (International Brazilian Jiu-Jitsu Federation), ONE Championship ও UFC-এর মতো পেশাদার সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী মার্শাল আর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। এসব প্রতিযোগিতা শুধু অ্যাথলেটদের জন্য নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং বৈচিত্র্যময় যুদ্ধশৈলীর সংরক্ষণে বিশাল ভূমিকা রাখে। এছাড়াও, ইউনেস্কো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা মার্শাল আর্টকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মানসিক-শারীরিক বিকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে বহু দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, স্কলারশিপ, স্পোর্টস অ্যাকাডেমি এবং প্রতিযোগিতামূলক লিগের মাধ্যমে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলে বলা যায়, মার্শাল আর্ট এখন আর শুধু ডোজো বা রিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক অংশে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার
মার্শাল আর্টের অনুশীলন একটি গভীর ও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, যা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু নিজেকে রক্ষা করার একটি কৌশল নয়, এটি একটি জীবনব্যাপী যাত্রা যা শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, সম্মান, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মিক বিকাশের চূড়ান্ত মিলন ঘটায়। মার্শাল আর্টের মাধ্যমে অনুশীলনকারীরা তাদের শারীরিক ক্ষমতা বাড়ায়, এছাড়া আত্মবিশ্বাস, মনোযোগ এবং ধৈর্যের মতো মানসিক গুণাবলীও অর্জন করে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগতে সহায়ক হয়। এটি একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ যা আত্মরক্ষা, ফিটনেস এবং মানসিক শক্তির অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে। আধুনিক সমাজে মার্শাল আর্টের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকাল, অনেক মানুষ জিমে যাওয়ার পরিবর্তে মার্শাল আর্টের ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে, যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য উভয়কেই সমৃদ্ধ করছে। মার্শাল আর্টের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ এবং সহায়ক কমিউনিটি তৈরি হয়, যেখানে সদস্যরা একে অপরকে উৎসাহিত করে এবং শিখতে পারে। এটি সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করার একটি কার্যকরী মাধ্যম, যা বিভিন্ন পেশার মানুষকে একত্রিত করে।
তাই, যদি আপনি আত্মরক্ষা, উন্নত শারীরিক সুস্থতা এবং একটি সুশৃঙ্খল মন পেতে চান, তবে মার্শাল আর্ট আপনার জন্য একটি আদর্শ পথ হতে পারে। মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ নিয়ে এর অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি নিজের শরীরের পাশাপাশি নিজের মনের ওপরও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারবেন, যা আপনাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
Feriwala-এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments