আসক্তি
আসক্তি কি? আসক্তি হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যার মধ্যে ক্ষতিকর পরিণতি থাকা সত্ত্বেও বাধ্যতামূলকভাবে কোন কার্য সম্পাদন করা হয়। আসক্তি মানুষের স্বাস্থ্য, সম্পর্ক এবং জীবনের সামগ্রিক গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে। আসক্তি একটি জটিল প্রক্রিয়া যেখানে পদার্থের ব্যবহার বা ব্যক্তির আচরণ, তার ও অন্যের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারে। নেতিবাচক ফলাফল সত্ত্বেও, নেতিবাচক পরিণতি সত্ত্বেও, আসক্ত ব্যক্তি সবকিছু বুঝেও এর থেকে সহজে মুক্ত হতে পারেনা।
![]() |
আসক্তি (Addiction) |
আসক্তি একদিনে বা হঠাৎ করে তৈরি হয়না। আসক্তি তৈরিতে অভ্যাসের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আসক্তি প্রতিকার ও আসক্তি প্রতিরোধ করতে কাজে লাগে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য “অভ্যাসঃ সফলতার চাবিকাঠি ও জীবন পরিবর্তনের পথ” নিবন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। তাই পাঠকের প্রতি আহ্বান থাকবে আসক্তি নিবন্ধের সাথে সাথে “অভ্যাসঃ সফলতার চাবিকাঠি ও জীবন পরিবর্তনের পথ” নিবন্ধটিও পড়ে দেখবেন।
আসক্তির প্রভাব
আসক্তি, যে কোনো ধরনের হোক না কেন, ব্যক্তি, পরিবার, এবং সমাজের ওপর গভীর এবং বহুমুখী প্রভাব ফেলে। এটি শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না, বরং মানসিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আসক্তির কিছু প্রধান প্রভাব নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
শারীরিক প্রভাব
আসক্তি থেকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন লিভার রোগ, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি। মাদকাসক্তি, অ্যালকোহল আসক্তি, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর আচরণ জনিত কারণে মৃত্যু হতে পারে। আসক্তি জনিত কারণে ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে, যা দুর্ঘটনা এবং আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
মানসিক প্রভাব
আসক্তি মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, এবং অন্যান্য মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। হঠাৎ মেজাজের পরিবর্তন, খিটখিটে মেজাজ, এবং আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আসক্তির কারণে ব্যক্তি মনোযোগের ঘাটতি অনুভব করতে পারে, যা দৈনন্দিন কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে।
পরিবারের ওপর প্রভাব
আসক্তি থেকে পারিবারিক অশান্তি, বিবাদ, এবং সম্পর্কের ভাঙন হতে পারে। আসক্তির কারণে শিশুরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তাদের বেড়ে ওঠা পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আসক্তির প্রভাব শুধু ব্যক্তির জীবনে নয়, পুরো সমাজে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া এবং তা প্রতিরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলি রোধ করা যায়। পেশাদার সাহায্য গ্রহণ করা, সমর্থন সিস্টেম তৈরি করা, এবং ইতিবাচক জীবনধারা অনুসরণ করা আসক্তি থেকে মুক্তির প্রধান উপায়।
সামাজিক প্রভাব
আসক্তির কারণে পারিবারিক, সামাজিক, এবং পেশাগত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আসক্ত ব্যক্তি অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অপরাধমূলক কার্যকলাপ: আসক্তি অনেক সময় ব্যক্তিকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়, যেমন চুরি, মাদক পাচার, বা সহিংসতা। আসক্তি সামাজিক মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতার ক্ষতি করতে পারে।
পেশাগত প্রভাব
আসক্তির কারণে ব্যক্তি কাজের স্থায়িত্ব হারাতে পারে এবং কর্মজীবনে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। আসক্তি কর্মজীবনে উন্নতি এবং সফলতার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
আসক্তি থেকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হতে পারে, যা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। আসক্তির কারণে কাজের প্রতি অনাগ্রহ এবং কর্মক্ষমতার হ্রাস ঘটে, যা কর্মজীবনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আসক্তি জনিত কারণে ব্যক্তির আর্থিক স্বাধীনতা হারাতে পারে, এবং তাদের পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে।
আইনি প্রভাব
আসক্তি থেকে অপরাধমূলক কার্যকলাপের ঝুঁকি বাড়ে, যা গ্রেফতার এবং আইনি সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আইনি ঝামেলা, যেমন চুক্তি ভঙ্গ, দেনা, এবং অন্যান্য আইনি সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
আসক্তির কারণ
আসক্তি একটি জটিল সমস্যা যার পিছনে একাধিক কারণ কাজ করে। আসক্তির কারণ বিভিন্ন হতে পারে, এবং এটি ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আসক্তি সাধারণত কিছু বিশেষ কারণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এখানে আসক্তির কিছু প্রধান কারণ তুলে ধরা হলো:
তাত্ত্বিক কারণ
- জৈবিক কারণঃ মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ আসক্তির একটি প্রধান কারণ। কিছু মানুষের জিনগতভাবে ডোপামিন সিস্টেমে ব্যাধি থাকতে পারে, যা তাদের আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
- মানসিক কারণঃ মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন বা হতাশা, উদ্বেগ, একাকিত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, আত্মসম্মানের অভাব ইত্যাদি মানসিক সমস্যাগুলো আসক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অনেকেই এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেতে আসক্তির দিকে আকৃষ্ট হয়।
- পরিবেশগত কারণঃ পরিবার, বন্ধু, সমাজ, এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ আসক্তির বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। যদি পরিবারে কারও আসক্তির ইতিহাস থাকে বা সামাজিক পরিবেশে আসক্তি স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়, তাহলে ব্যক্তিটির আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- জেনেটিক প্রভাবঃ আসক্তির ক্ষেত্রে জেনেটিক ফ্যাক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের মধ্যে কেউ আসক্ত থাকলে, অন্য সদস্যদের আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- সামাজিক চাপঃ সামাজিক চাপ, প্রতিযোগিতা এবং সফল হওয়ার চাপও আসক্তির একটি কারণ হতে পারে। অনেকেই এই চাপ মোকাবিলা করতে না পেরে আসক্তির দিকে আকৃষ্ট হয়। এছাড়াও কিশোর-কিশোরীরা বন্ধুদের চাপে বা তাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য আসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
- আনন্দের খোঁজঃ কিছু মানুষ নেশাজাতীয় পদার্থ বা আচরণে তাৎক্ষণিক আনন্দ বা উত্তেজনা পেতে চান, যা আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যঃ কিছু ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, যেমন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, উত্তেজনা খোঁজা, এবং কম আত্মনিয়ন্ত্রণ আসক্তির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- ট্রমা বা জীবনের চ্যালেঞ্জঃ বিভিন্ন ট্রমা, যেমন শৈশবে নির্যাতন, প্রিয়জনের মৃত্যু, প্রেমের ব্যর্থতা বা বড় কোনো চ্যালেঞ্জ আসক্তির দিকে ধাবিত করতে পারে। এটি ব্যথা বা কষ্ট থেকে সাময়িক মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে।
- বায়োকেমিক্যাল পরিবর্তনঃ নেশাজাতীয় পদার্থ মস্তিষ্কের রসায়নকে প্রভাবিত করে, যা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের ফলে আসক্তির সৃষ্টি করে। মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রগুলি এই পদার্থ বা আচরণে সংযুক্ত হয়ে পড়ে।
- সহজলভ্যতাঃ নেশাজাতীয় পদার্থ বা আসক্তি তৈরি করার মতো আচরণের সহজলভ্যতা আসক্তির কারণ হতে পারে। যখন এগুলো সহজেই পাওয়া যায়, তখন আসক্তি বাড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এই কারণগুলো একত্রে বা আলাদাভাবে কাজ করে আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে। আসক্তি একটি জটিল সমস্যা, যা ব্যক্তি, পরিবেশ, এবং জীবনের নানা উপাদানের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন ধরনের আসক্তি ও তাদের নির্দিষ্ট কারণ
আসক্তির বিভিন্ন ধরনের কারণগুলি একত্রে বা আলাদাভাবে কাজ করে। আসক্তি একটি জটিল মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট পদার্থ, কাজকর্ম বা অন্য কোনো কিছুর প্রতি অত্যধিক ঝোঁক দেখায় এবং তা ছাড়া থাকতে পারে না। এই ঝোঁকটি এতটাই প্রবল হয় যে এটি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন, সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আসক্তি বুঝতে এবং মোকাবেলা করতে পেশাদার সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের আসক্তি ও তাদের কারণগুলি উল্লেখ করা হলোঃ
পদার্থ আসক্তি (Substance Addiction)
পদার্থ আসক্তি বলতে মূলত মাদকাসক্তিই বুঝায়। পদার্থ বা মাদকাসক্তির কারণগুলি সাধারণত জেনেটিক প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, সামাজিক চাপ, পারিবারিক প্রভাব, এবং শারীরিক সংবেদনশীলতা থেকে উদ্ভূত হয়। ব্যক্তির কৌতূহল, বিপদপূর্ণ আচরণ, এবং চাপ থেকে পালানোর প্রবণতাও মাদকাসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। সহজলভ্যতা এবং প্রাথমিক এক্সপোজার এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- অ্যালকোহল আসক্তিঃ পারিবারিক ইতিহাস, মানসিক চাপ, সামাজিক চাপ, এবং সহজলভ্যতা।
- ড্রাগস আসক্তিঃ জেনেটিক প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, সমাজের চাপ, এবং নেশাজাতীয় পদার্থের সহজলভ্যতা।
- নিকোটিন আসক্তিঃ পারিবারিক প্রভাব, সামাজিক চাপ, এবং তামাকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা।
আচরণগত আসক্তি (Behavioral Addiction)
আচরণগত আসক্তির কারণগুলির মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন উদ্বেগ বা ডিপ্রেশন, সামাজিক চাপ, এবং পুরস্কারের অনুভূতির প্রতি মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত। অতিরিক্ত চাপ, জীবনের অস্থিরতা, এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাবও আচরণগত আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- পর্ণোগ্রাফি আসক্তিঃ যৌন উত্তেজনার প্রয়োজন, মানসিক চাপ থেকে মুক্তি, এবং সহজলভ্যতা।
- যৌন আসক্তিঃ অতিরিক্ত যৌন চিন্তা বা কাজকর্ম, একাকীত্ব, এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি।
- গেমিং আসক্তিঃ বাস্তব জীবনের চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা, সামাজিক যোগাযোগের অভাব, এবং গেমের দ্বারা মনোরঞ্জন।
- জুয়া আসক্তিঃ আর্থিক লাভের আশায়, উত্তেজনা খোঁজা, এবং জুয়ার সহজলভ্যতা।
- ইন্টারনেট আসক্তিঃ সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেমিং, এবং ভার্চুয়াল বিশ্বের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ।
- খাদ্য আসক্তিঃ মানসিক চাপ, একাকীত্ব, এবং খাদ্য দ্বারা সান্ত্বনা খোঁজা।
- শপিং আসক্তিঃ মানসিক চাপ থেকে মুক্তি, সামাজিক চাপ, এবং কেনাকাটা দ্বারা উত্তেজনা অনুভব করা।
ডিজিটাল আসক্তি (Digital Addiction)
ডিজিটাল আসক্তির কারণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সামাজিক যোগাযোগের আকর্ষণ, সহজলভ্যতা, এবং তাৎক্ষণিক পুরস্কারের প্রতি মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন উদ্বেগ বা ডিপ্রেশন, এবং বাস্তব জীবনের চাপ থেকে পালানোর প্রবণতাও এই আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিঃ সামাজিক যোগাযোগের প্রয়োজন, স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, এবং অভ্যাসগত ব্যবহার।
- স্মার্টফোন আসক্তিঃ সোশ্যাল মিডিয়া, গেমস, এবং বার্তালাপের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা।
মানসিক আসক্তি (Psychological Addiction)
মানসিক আসক্তির কারণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, এবং অতীতের ট্রমা। আত্মবিশ্বাসের অভাব, সামাজিক চাপ, এবং আবেগগত কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ক্ষতিকর আচরণ বা পদার্থের প্রতি নির্ভরশীলতাও মানসিক আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- কাজের আসক্তিঃ পেশাদার সাফল্য, আর্থিক নিরাপত্তা, এবং সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন।
- প্রেম বা সম্পর্কের আসক্তিঃ আবেগের অভাব, একাকীত্ব, এবং সম্পর্কের মাধ্যমে স্বীকৃতি বা নিরাপত্তার অনুভূতি।
- স্ব-ধ্বংসাত্মক আচরণের আসক্তিঃ মানসিক কষ্ট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, এবং স্ব-কষ্টের প্রতি আকর্ষণ।
খাদ্য ও পানীয় আসক্তি (Food and Drink Addiction)
খাদ্য ও পানীয় আসক্তির কারণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ডিপ্রেশন বা উদ্বেগ, আবেগগত কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা, এবং তাৎক্ষণিক আনন্দের অনুভূতির প্রতি মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। এছাড়া জেনেটিক প্রভাব, সামাজিক চাপ, এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসও এই আসক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- মিষ্টি ও ফাস্টফুড আসক্তিঃ তাৎক্ষণিক শক্তির প্রয়োজন, মিষ্টি, চকোলেট, আইসক্রিম ও ফাস্টফুডের প্রতি প্রাকৃতিক আকর্ষণ, এবং মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য খাওয়া।
- ক্যাফেইন আসক্তিঃ মানসিক সতর্কতা, দৈনন্দিন জীবনে ক্যাফেইনের অভ্যস্ত ব্যবহার, এবং ক্যাফেইনের সহজলভ্যতা।
আসক্তি কত প্রকার?
আসক্তি প্রধানত দুই প্রকার। যথা- ১। পদার্থ আসক্তি ও ২। আচরণগত আসক্তি
১। পদার্থ আসক্তি (Substance Addiction)
এই আসক্তি একটি ভয়ঙ্কর রোগ দ্বারা আটকে থাকা জীবনকে বর্ণনা করে। যা শুরু হয় কৌতূহলো বা জীবনের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য। এই কৌতূহলো বা সমস্যা মোকাবিলা করার পদ্ধতি দ্রুত একটি ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে। এটি বিশেষ কিছু বস্তুর উপর আসক্তি সৃষ্টি করে যা ধীরে ধীরে জীবনকে অর্থহীন করে তোলে, নিকটতম সম্পর্কগুলোকে আঘাত করে, তখন এই আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে।
পদার্থের আসক্তি একটি জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা মানুষের জীবনে ক্ষতিকারক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ঐ পদার্থের ব্যবহারের বাধ্যতামূলক প্রয়োজন মনে করা হয়। বারবার এর অপব্যবহার মস্তিষ্কের রসায়নকে প্রভাবিত করে যার ফলে মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই আসক্তি মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে (Nucleus Accumbens) ডোপামিন দিয়ে প্লাবিত করে, যা আনন্দের অনুভূতিকে সৃষ্টি করে। ডোপামিন এমন আচরণগুলো পুনরাবৃত্তি করতে অনুপ্রাণিত করে। আসক্তি সৃষ্টিকারী মাদক এবং অ্যালকোহলের মতো পদার্থ মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে অতিরিক্ত উদ্দীপিত করে এবং তীব্র আনন্দদায়ক এক অনুভূতি তৈরি করে। এই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতি মানুষকে বারবার সেই পদার্থটি খুঁজে বের করার জন্য প্ররোচিত করে। সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্ক অতিরিক্ত ডোপামিনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এবং ব্যবহারকারীরা একই প্রভাব অনুভব করার জন্য সেই পদার্থের প্রতি আরও বেশি প্রয়োজনবোধ করে। এটাই হলো পদার্থের আসক্তির একটি চক্র। অনেকে শুধু রিল্যাক্স করতে, মজা করতে, পরীক্ষা করতে বা মানসিক চাপ মোকাবেলা করার জন্য সাময়িকভাবে ড্রাগ বা অ্যালকোহলের মতো পদার্থ ব্যবহার করে। এই বিষয়টি আসক্তির মধ্যে পড়েনা। আসক্তি সেটাই যেটা বারবার ব্যবহার করার জন্য মনে একরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। চিনি, আইসক্রিম ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় অন্যান্য মিষ্টি খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার এবং ক্যাফিনের মতো কিছু খাবার পদার্থ আসক্তির মধ্যে পড়ে যায়। যদিও এগুলো মাদক নয় এবং এগুলো প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করতে সহায়তা করে তবে এই উপাদানগুলো শারিরীক স্বাস্থ্যের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ।
পদার্থ আসক্তির উদাহরণ:
মদ বা অ্যালকোহলো, গাঁজা, হেরোইন, কোকেন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, ক্যাফেইন, এলএসডি (LSD), তামাক/নিকোটিন (যেমন ধূমপান সিগারেট এবং ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং), বিভিন্ন ইনহেল্যান্ট (যেমন পেইন্ট থিনার, অ্যারোসল স্প্রে, গ্যাস, ড্রেনড্রাইট ইত্যাদি), ঘুমের ওষুধ সহ অন্যান্য প্রেসক্রিপশন এবং নন-প্রেসক্রিপশন আইটেম ইত্যাদি। যদিও এই পদার্থগুলো একে অপরের থেকে খুব আলাদা, তারা সবগুলো মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে (Nucleus Accumbens) দৃঢ়ভাবে সক্রিয় করে এবং তীব্র আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। এই দ্রব্যগুলোর ব্যবহারে গুরুতর শারিরীক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
২। আচরণগত আসক্তি (Non-substance Addiction)
একটি আচরণগত আসক্তি মাদক জড়িত নয় এমন সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। ঝুঁকিপূর্ণ যৌনতা, খাদ্য এবং অন্যান্য অ-পদার্থের আসক্তিকে আচরণগত আসক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যে কোনো সময় একজন ব্যক্তি নিয়মিতভাবে এমন কোনো আচরণে লিপ্ত হন যাকে সে উদ্দীপক বলে মনে করে, তারা মস্তিষ্কে ডোপামিনের ভিড় অনুভব করে। পদার্থ আসক্তির মতো তীব্রভাবে ডোপামিনের প্রভাব তৈরি না হলেও আচরণগত আসক্তি মস্তিষ্কের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে (Nucleus Accumbens) উদ্দীপিত করতে সক্ষম। আচরণগত আসক্তি উদাহরণগুলো দৈনন্দিন অভ্যাসজনিত কাজের সাথে সামঞ্জস্যমূলক মনে হলেও এর অভাবে মানসিক প্রতিক্রিয়া ভিন্ন।
প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে অন্যান্য ক্রিয়াকলাপগুলো আচরণগত আসক্তি হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। ইন্টারনেট আসক্তি, ফোন আসক্তি, এমনকি ভিডিও গেমের আসক্তি একটি ব্যক্তির জীবনে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যৌনতার জন্য একটি অনিয়ন্ত্রিত তৃষ্ণা নিজেকে স্বাভাবিক যৌনতার বাইরেও অনেক উপায়ে প্রকাশ করতে পারে। জুয়াখোর নিজের জীবনের সঞ্চিত সম্পদ ধংস করতে পারে, পরবর্তিতে একজন অপরাধীতে পরিণত করতে পারে। ঘুষখোর তার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সমাজ রাষ্ট্রকে ধংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এইরকম আসক্তির অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেগুলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবার জন্যই অকল্যানকর। তবে বর্তমানে সেল ফোন, ইন্টারনেট ছাড়া চলা প্রায় অসম্ভব, আমরা খাবার ছাড়া অনাহারে থাকব, যৌন আসক্তি বা সেক্স করা জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তাই এইসব আচরণ আমরা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে পারি না, তবে আমাদের প্রয়োজন এগুলোর একটা সীমানা নির্ধারণ করা এবং এইসব আচরণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আমাদের ভিডিও গেম, সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতেই হবে, না করতে পারলে শেষ হয়ে যাবো, থাকতে পারবোনা, মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে ইত্যাদি হলো আচরণগত আসক্তি। আমাদের এই আচরণগুলো নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে, ভিডিও গেম, সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারে বাঁধা আসলে কি হবে? হয়তো কিছুটা খারাপ লাগবে, একটু খারাপ লাগতেই পারে, এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা অভ্যাসে বাঁধা পেলে মানুষ দেখায়। জুয়া খেলা, ঘুষ খাওয়া, যৌন আসক্তি, পর্ণগ্রাফি দেখা এগুলো হলো আচরণগত আসক্তির প্রধান উদাহরণ যা মানসিক অসূস্থ্যতাকেই প্রকাশ করে। মানুষের এইসব কার্যকলাপ দৈনন্দিন কার্যকারিতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে তা উল্লেখযোগ্য মানসিক, সামাজিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
আচরণগত আসক্তির উদাহরণ:
জুয়া, ঘুষ খাওয়া, খাবারের প্রতি আসক্তি, ব্যায়াম বা ডায়েটিং, কেনাকাটা, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, যৌন আসক্তি, পর্ণগ্রাফি দেখা, ভিডিও গেমিং, মোবাইল আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি, ধর্মবিশ্বাস, প্রেম ইত্যাদি।
আসক্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?
আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া, তবে সঠিক পদক্ষেপ এবং সহায়তা গ্রহণ করে আসক্তি পুনরুদ্ধার সম্ভব। মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী কিছু কার্যকর কৌশল উল্লেখ করা হলো যা আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারেঃ
- স্বীকৃতি এবং সচেতনতাঃ প্রথম ধাপ হলো নিজের আসক্তি স্বীকার করা এবং এটি আপনার জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা বোঝা।
- পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্য নিনঃ আপনার আসক্তির কথা পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। তাদের সমর্থন এবং উৎসাহ আপনাকে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করবে।
- বিকল্প আচরণ গড়ে তুলুনঃ পুরনো আসক্তির পরিবর্তে নতুন এবং ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেমন, সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, বই পড়া, বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে পুরোনো জীবনধারার পরিবর্তন করুন।
- ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুনঃ আপনার আসক্তি মোকাবেলার জন্য ছোট ছোট, বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং সেই অনুযায়ী অগ্রসর হন।
- পরিবেশ পরিবর্তন করুনঃ আপনার আসক্তির ট্রিগারগুলো চিহ্নিত করুন এবং সেই পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন। নতুন, ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করুন যা আপনাকে সহায়তা করবে। উল্লেখ্য এখানে “ট্রিগার কি? ট্রিগার কিভাবে কাজ করে?” এই বিষয়ে “অভ্যাসঃ সফলতার চাবিকাঠি ও জীবন পরিবর্তনের পথ” নিবন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে।
- মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিনঃ পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য, এবং নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
- ধৈর্য ধরুনঃ আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া ধীরে ধীরে হতে পারে। ধৈর্য ধরে থাকুন এবং প্রতিদিনের অগ্রগতি মনিটর করুন।
- ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলুনঃ নতুন এবং ইতিবাচক মানুষের সঙ্গে সময় কাটান যারা আপনার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
- সমর্থন গ্রুপে যোগদান করুনঃ আসক্তি মোকাবেলা করার জন্য সমর্থন গ্রুপে যোগ দিন। এই গ্রুপগুলি সাধারণত একে অপরকে সাহায্য করে এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।
- নিজের প্রতি সহানুভূতি রাখুনঃ অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিন এবং নিজেকে ক্ষমা করুন। নিজেকে বিচলিত না করে ধৈর্য ধরে লক্ষ্য অর্জনে মনোনিবেশ করুন।
- মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিনঃ আসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। তারা আপনাকে সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা, থেরাপি, বা কাউন্সেলিং প্রদান করতে পারেন। আসক্তির চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকগণ অত্যন্ত কার্যকরী চিকিৎসাপদ্ধতি, যেমন- আচরণগত থেরাপি (আসক্তিজনিত আচরণগুলো পরিবর্তন করতে), কগনিটিভ-বিহেভিয়ারাল থেরাপি (আসক্তির পেছনের চিন্তাধারাগুলোকে বদলে দিতে) এবং দলগত থেরাপি (অন্যান্য আসক্ত ব্যক্তির সাথে মিলে মিশে চিকিৎসা করা) ইত্যাদি প্রদান করতে পারেন। এছাড়াও আসক্তির লক্ষণগুলো কমাতে এবং মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, সেগুলো নিয়মিত সেবন করা আবশ্যক। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে পুনর্বাসন কেন্দ্রেও থাকতে হতে পারে। সম্পূর্ণরূপে আসক্তি নিরাময় হতে বেশ সময় লাগবে, আসক্তি মুক্তি হতে আসক্ত ব্যক্তিকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে।
নির্দিষ্ট কোন আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
মোবাইল আসক্তির কুফল বর্তমানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ডুকে গেছে। এটি এমন একটি আসক্তি যেখান থেকে অন্যান্য অনেক আসক্তির জন্মলাভ করে। এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে যা করণীয় তা হলো- আসক্তির ট্রিগার খুঁজে বের করা, ফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করা, স্ক্রীন টাইম ট্র্যাকিং অ্যাপ ডাউনলোড করা যাতে দিনে কতটা স্ক্রীন টাইম ছিল এটি বুঝা যায়, ঘুমোনোর সময় ফোন বন্ধ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি উপায়ে মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ করা যেতে পারে।
শিশুদের মোবাইল আসক্তি কমানোর উপায়
শিশুদের মোবাইল আসক্তি কমানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আমরাই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল তুলে দেই, আমদের কারনেই বাচ্চারা আসক্ত হয় আবার আমরাই বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি কমানোর উপায় খুঁজি। শিশুদের কোনমতেই মোবাইল দেয়া যাবেনা, ওদের সামনে মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে, যদি দিতেই হয় তাহলে নির্দিষ্ট টাইম বেঁধে ও শুধু শিক্ষামূলক বিষয় দেখবে এই শর্তে মাঝেমাঝে দেয়া যেতে পারে তাছাড়া শিশুর সাথে খেলাধূলা করা, ওদের মুক্তাঙ্গনে খেলার সুযোগ দেওয়া, সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা ইত্যাদি উপায়ে শিশুদের মোবাইল আসক্তি কমানো যেতে পারে।
কারো প্রতি আসক্তি কমানোর উপায়
কারো প্রতি আসক্তি কমাতে চাইলে প্রথমেই তার সাথে টোটাল ডিসকানেক্টেড হতে হবে? নিজেকে অন্যকোন জটিল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাকে মাঝেমধ্যে মনে পড়লে তাৎক্ষণিক মনকে অন্যকোন বিষয়ে ডাইভার্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে ছেলেবেলার স্মৃতি খুব ভালো কাজ দেয়। কারন ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো আমাদের মনে ভালোলাগার সৃষ্টি করে। আর মাঝেমধ্যে কেন মনে পড়ে, কোন সিচুয়েশনে মনে পড়ে সেই ট্রিগার খুঁজে বের করতে হবে। ট্রিগার পরিবর্তনের মাধ্যমে কারো প্রতি আসক্তি ধীরেধরে কমানো যেতে পারে।
পর্ণোগ্রাফি আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
পর্ণোগ্রাফি আসক্তি ভয়াবহতা ও মুক্তির উপায় সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। পর্ণ আসক্তির ব্যক্তিগত প্রভাব ধ্বংসাত্মক হতে পারে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, মানসিক স্বাস্থ্য, এবং ব্যক্তির পাশাপাশি তাদের বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সামগ্রিক মঙ্গলকে প্রভাবিত করে। তাই পর্ণগ্রাফিতে অ্যাক্সেস বাদ দিতে হবে। এর জন্য সমস্ত পর্ণগ্রাফিক উপাদান মুছে ফেলা হলো বাস্তব এবং ডিজিটাল উভয়ই আসক্তিতে অবদান রাখতে পারে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসে পর্ণগ্রাফিক বিষয়বস্তু এবং সাইটগুলি ব্লক করার জন্য ফিল্টার ইনস্টল করা পর্ণগ্রাফিতে অ্যাক্সেস বাদ দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রলোভনকে সরিয়ে দেয়। পর্ণ আসক্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য স্বাস্থ্যকর মোকাবিলা পদ্ধতির বিকাশ একটি অপরিহার্য দিক। ব্যায়াম, ধ্যান বা নতুন আগ্রহের অন্বেষণের মতো ক্রিয়াকলাপের সাথে পর্ণ দেখার অভ্যাস প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তিদের তাদের আসক্তি ভাঙতে সহায়তা করতে পারে। এছাড়া ভিডিও গেম খেলা বা নতুন শখ অনুসরণ করা হল পর্ণগ্রাফি দেখার উপকারী বিকল্পের উদাহরণ। প্রয়োজনে পর্ণ আসক্তি থেকে মুক্তিতে পেশাদার সহায়তা পেতে থেরাপিস্ট বা আসক্তি বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
অ্যালকোহল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
অ্যালকোহল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়গুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অ্যালকোহল আসক্তির চিকিৎসা গ্রহণে পেশাদার চিকিৎসার সহায়তা নেয়া, মনোবিদের সাথে থেরাপি, পারিবারিক এবং সামাজিক সমর্থন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, এবং নতুন ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলা। ধৈর্য সহকারে ধাপে ধাপে লক্ষ্য অর্জন এবং সমর্থন সিস্টেম তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
ধুমপান থেকে মুক্তির উপায়
ধুমপান থেকে মুক্তির উপায়গুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ধুমপান ছাড়ার পরিকল্পনা তৈরি করা, পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা গ্রহণ, নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, এবং সঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক সমর্থন। সঠিক তথ্য ও উৎসাহ, নতুন স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা, এবং ধুমপানের ট্রিগার এড়ানোও সহায়ক হতে পারে। ধুমপান থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে পূর্ণ একটি নিবন্ধ লেখার ইচ্ছা আছে।
ধর্মবিশ্বাস কি আসক্তি?
বিশেষজ্ঞের মতানুযায়ী ধর্মশ্বিাস আসক্তির মধ্যেই পড়ে। এই আসক্তিকে আধ্যাত্মিক আসক্তি লা হয়। ধর্ম আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের সহজাত ভয়কে ব্যবহার করে শারীরিক বা মানসিক আসক্তি সৃষ্টি করে। ধর্ম মানুষের মৃত্যুর ভয়কে জড়িত করে এবং মৃত্যু পরবর্তী অজানা শাস্তি বা পুরষ্কার পাবার সম্ভাবনায় মানুষ ধর্ম-কর্মের আসক্তিতে পড়ে জীবন অতিবাহিত করে। তবে সব ধর্ম-কর্ম আসক্তির মধ্যে পড়েনা কিছু কর্ম শুধুই অভ্যাসগত। ধর্মের আসক্তি সাধারণত কল্যাণকর হিসেবেই দেখা হয় তবে অন্ধবিশ্বাসী কিছু মানুষ কুসংষ্কারে নিমজ্জিত হয়ে সমাজ নষ্ট করে, নিজের বিশ্বাসকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। ধর্মের প্রতি অতি আসক্তির কারনে দুইজন ভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তি একে অপরের সাথে তর্ক বা মারামারিতেও লিপ্ত হয়। তবে ধর্মের প্রতি আসক্তি মানুষকে একজন অহিংস, নির্লোভ, মানবিক, আদর্শ মানুষ হিসেবেও গড়ে তোলে। এই আসক্তি ফলে মানুষের আচরণ কেমন হবে সেটা তার ধর্মীয় শিক্ষা, পরিবার ও সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভর করে।
প্রেম কি আসক্তি?
রোমান্টিক প্রেমকে এক ধরনের আচরণগত আসক্তি বা অসুস্থতা হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রিয়জন সম্পর্কে ধ্রুবক চিন্তাভাবনা এবং নির্দিষ্ট কার্যকলাপ জড়িত। কিন্তু একজন ব্যক্তির সাথে এই ধরনের ক্রমাগত ব্যস্ততা বা একই আচরণ কি উপকারী হতে পারে নাকি ক্ষতিকর, এটা ভাবার বিষয়। প্রেমের শক্তির কাছে নিজের ইচ্ছাশক্তির বারবার হেরে যায়, ঠিক আসক্তির ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এই কারনে প্রেমকে আসক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে প্রেম এবং আসক্তির মধ্যে একটি বাস্তব পার্থক্য আছে? আসক্তি আসলে প্রেমের কয়েকটি দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে প্রেমে আসক্তি নেই সেটা প্রেম নয় কোনমতেই। প্রেমাসক্তদের মধ্যে যারা আসক্তির চরম লেভেলে চলে যায় তারা পরিস্থিতি মেনে নিতে পারেনা তাই তারা পালিয়ে যায়, মাদকাসক্তিতে মনোযোগ দেয় অথবা আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়। এই ধরনের আসক্ত মানুষকে সূস্থ করতে হলে সঠিক শারিরীক ও পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
আসক্তি ও অভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য
উভয় ধরনের আচরণের মধ্যেই স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা জড়িত। তবে দুটির মূল পার্থক্য হলো যে আসক্তি একটি বাধ্যতামূলক ধরনের আচরণকে প্রতিফলিত করে। যে বিষয়ের প্রতি আসক্তি সে বিষয়ে কোন বাঁধা বা নিষেধাজ্ঞার সৃষ্টি হলে মনে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, ঐ আসক্তির জিনিষটি লাগবেই, না পেলে অবিরত পাওয়ার চেষ্টা করবে, সারাক্ষণ ঐ চিন্তায়ই মগ্ন থাকবে এবং মনের ভিতরে একটা রাগী ও অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে বিষন্নতায় দিন কাটাবে। আর যদি এটি একটি নিছক অভ্যাস হয়, তাহলে বাঁধা আসলে মনে এই উপলব্ধি হবে "আমার কাজটি করা উচিত" বা সেই কাজের সময়, সুযোগ পেরিয়ে গেলে মনে একটু আফসোসের সৃষ্টি হতে পারে। মোটকথা অভ্যাসজনিত কাজে বাঁধা আসলে মনে তেমন ইফেক্ট পড়েনা (যদি না বাঁধা দীর্ঘদিনের জন্য না হয়) আর আসক্তিতে মনের ইফেক্ট ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে পারে। সাধারণত, যেগুলো মানুষকে বেঁচে থাকতে এবং উন্নতি করতে সাহায্য করে, যেমন খাওয়া, যৌনতা, পছন্দের বা ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা বলা বা সময় কাটানো ইত্যাদি হলো অভ্যাস যা সাময়িক বাঁধাপ্রাপ্ত হলে মানুষ মেনে নেয় কিন্তু যদি মেনে না নেয় এবং সেজন্য মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তাহলে সেটা আসক্তি। অভ্যাস হলো দৈনন্দিন জীবনধারা আর আসক্তি হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা, কোন কোন ক্ষেত্রে আসক্তি একধরনের মানসিক রোগ। কোন কাজের অভ্যাস মনে ভালো লাগা সৃষ্টি করলে ঐ কাজটির প্রতি ধীরে ধীরে আসক্তি তৈরি করে। মোবাইল আসক্তি, ভিডিও গেম, পর্ণগ্রাফী, প্রেম ইত্যাদি হলো অভ্যাসজনিত কারনে আসক্তিতে পরিণত হওয়ার বড় উদাহরণ।
উপসংহার
আসক্তি একটি জটিল এবং বহুমুখী অবস্থা যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এটি ক্ষতিকারক পরিণতি সত্ত্বেও একটি আচরণ বা পদার্থে বাধ্যতামূলক নিযুক্তি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। আসক্তি একজন ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা, সম্পর্ক এবং জীবনের সামগ্রিক মান। এটি প্রায়শই জেনেটিক, পরিবেশগত এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত হয়, যা এটিকে অতিক্রম করা একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থা করে তোলে। এটা স্বীকার করা অপরিহার্য যে আসক্তি একটি নৈতিক ব্যর্থতা নয় বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা অবস্থা যার জন্য সমবেদনা, বোঝাপড়া এবং প্রমাণ-ভিত্তিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি করে, কলঙ্ক হ্রাস করে মোটিভেশন ও চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর এবং আরও পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতে সহায়তা করতে পারি।
সচরাচর-জিজ্ঞাস্য
১। প্রশ্নঃ আসক্তি, নেশা ও অভ্যাস কি এক?
উত্তরঃ অনেকেই আসক্তি, নেশা ও অভ্যাসকে এক মনে করেন। এটা সঠিক নয় এই তিনটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। কোন কাজ বা দৈনন্দিন কাজ ধারাবহিকভাবে করতে করতে সেই কাজ অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং, অভ্যাস হলো একটি আচরণগত প্যাটার্ন যা আমরা নিয়মিত বিরতিতে প্রায়শই পুনরাবৃত্তি করি। আবার কোন কাজের অভ্যাস মনে ভালোলাগা সৃষ্টি করলে সেই কাজের ধারাবাহিক অভ্যাসের কারনে আসক্তিতে পরিণত হয়। সুতরাং আসক্তি হলো মনের ক্রিয়াশীল একটা অবস্থা। আর নেশা হলো নির্দিষ্ট বিরতিতে বা ধারাবাহিকভাবে বিশেষ কোন পদার্থ গ্রহন করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে সুখ খোঁজার চেষ্টা করা। নেশা ধারাবাহিক অভ্যাসে ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হয়।
২। প্রশ্নঃ আসক্তি কাকে বলে?
উত্তরঃ আসক্তি হল একটি শক্তিশালী মানসিক আকর্ষণ। যখন একটি শক্তিশালী শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজন বা কিছু করার বা কিছু ব্যবহার করার তাগিদ অনুভব করা হয় এই তাগিদের বিষয়টিকেই আসক্তি বলা হয়। এটি একটি পদার্থ বা কার্যকলাপের উপর নির্ভরতা এমনকি যদি মানুষ জানে যে এটি ক্ষতিকার তবু এটি করে বা করতে চায়।
৩। প্রশ্নঃ আসক্তি কি সত্যিই একটি রোগ?
উত্তরঃ বেশিরভাগ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন দ্বারাই আসক্তিকে একটি রোগ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো, আসক্তিও একটা রোগ।
৪। প্রশ্নঃ আসক্তির কারণ কি?
উত্তরঃ আসক্তির কোনো একক কারণ নেই - এটি একটি খুব জটিল অবস্থা। আপনার মস্তিষ্কের রসায়নের পরিবর্তনের মাধ্যমে আসক্তি কীভাবে বিকাশ লাভ করে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। পদার্থ এবং কিছু ক্রিয়াকলাপ আপনার মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে আপনার মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্র। মানুষ পুরষ্কার চাইতে জৈবিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়।
৫। প্রশ্নঃ আমাদের আসক্তির মূল কি?
উত্তরঃ পদার্থের অপব্যবহার এবং আসক্তির প্রায় সবসময়ই অন্তর্নিহিত কারণ থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদী আসক্তির অবসান ঘটানোর জন্য আসক্তির এই শিকড়গুলিকে অবশ্যই সমাধান করতে হবে। আসক্তির সবচেয়ে সাধারণ শিকড় হল দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস, ট্রমার ইতিহাস, মানসিক অসুস্থতা এবং আসক্তির পারিবারিক ইতিহাস।
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments