প্রেমের বিবর্তন
প্রেমের বিবর্তন একটি আকর্ষণীয় এবং গভীর বিষয়, যা মানব সমাজ, সংস্কৃতি, এবং মনস্তত্ত্বের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রেমের ধারণা এবং তার প্রকাশভঙ্গি সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তন বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগ, সামাজিক কাঠামো, এবং সংস্কৃতির প্রভাবের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
প্রেমের বিবর্তন। Photo by pixabay.com |
বিভিন্ন যুগের প্রেম
প্রাচীনকালের প্রেম
প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে, যেমন মিশরীয়, গ্রীক, এবং রোমান সংস্কৃতিতে, প্রেমকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো। গ্রীকরা প্রেমকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছিল, যেমন "এরোস" (যৌন প্রেম), "ফিলিয়া" (বন্ধুত্বপূর্ণ প্রেম), এবং "আগাপি" (নিঃস্বার্থ প্রেম)। প্রেমের এই ধারণাগুলি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
মধ্যযুগের প্রেম
মধ্যযুগে প্রেমের ধারণা বিশেষ করে ইউরোপে রোমান্টিক হয়ে ওঠে। এই সময়ে "চিভ্যালরিক প্রেম" বা "কোর্টলি লাভ" ধারণা জন্ম নেয়, যেখানে একজন নাইট তার প্রিয়ার জন্য নানান দুঃসাহসিক কাজ করত। এই যুগে প্রেমকে পবিত্র, নিষ্ঠাবান এবং মহৎ একটি আবেগ হিসেবে দেখা হতো।
পুনর্জাগরণ এবং প্রণয়ধর্মী প্রেম
পুনর্জাগরণের সময়ে প্রেম আরও জটিল ও মানবিক হয়ে ওঠে। শিল্প, সাহিত্য এবং নাটকে প্রেমের রোমান্টিক, ট্র্যাজিক, এবং মানবিক দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছে। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলি প্রেমের বিভিন্ন রূপ ও চ্যালেঞ্জকে প্রকাশ করে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
আধুনিক যুগের প্রেম
১৮০০ সালের পর থেকে প্রেমের ধারণা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোমান্টিসিজমের প্রভাব এই সময়ে প্রেমকে আরও আবেগপ্রবণ এবং ব্যক্তিগত বানিয়েছে। ১৯ শতকের প্রেমের উপন্যাসগুলোতে ব্যক্তিগত আবেগ, স্বপ্ন এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে সংঘর্ষকে তুলে ধরা হয়েছে।
আধুনিক এবং সমসাময়িক প্রেম
২০ ও ২১ শতকে প্রেমের ধারণা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রেমের সম্পর্কগুলি আজকাল আরও সমতা, স্বাধীনতা, এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। প্রযুক্তির আবির্ভাব, যেমন সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন ডেটিং, প্রেমের সম্পর্ককে আরও জটিল এবং বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। বর্তমানে, প্রেমের ধারণা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে, যেখানে লিঙ্গ, জাতি, এবং যৌন অভিমুখের ভিত্তিতে বৈষম্য কমেছে।
ভবিষ্যতের প্রেম
প্রেমের বিবর্তন আজও চলমান, এবং প্রযুক্তি, বৈশ্বিক পরিবর্তন, এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রেমের ভবিষ্যত ধারণা কীভাবে গড়ে উঠবে, তা দেখার বিষয়।
সংক্ষেপে, প্রেমের বিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা সময়ের সাথে সাথে সমাজ, সংস্কৃতি, এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রেমের এই বিবর্তন আমাদের বর্তমান সমাজের সম্পর্কের মূল ভিত্তি গঠন করেছে।
আধুনিক এবং সমসাময়িক প্রেমের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
দিন বদলায়, দিন বদলের সাথে সাথে বদলে যায় সবকিছু। দিন বদলের সাথে সাথে বদলে যায় মানুষের আচরণ, অনুভূতি ও ভালোবাসা। দিন বদলের সাথে প্রেমের বিবর্তন হয়েছে, প্রেমের সম্পর্কের মাঝেও যে আদর্শগত পরিবর্তন হয়েছে সেই বিষয়ের উপরই মূল ফোকাস থাকবে। সেকালের প্রেম এবং একালের প্রেমের তুলনামূলক আলোচনা করবো। প্রেমের সেকাল আর একাল বলতে মূলত নব্বইয়ের দশকের প্রেমের ইতিহাস ও বর্তমান যুগের প্রেমের পরিবর্তন বা প্রেমের রুপান্তর। নব্বইয়ের দশকের প্রেমকে হর-হামেশাই আদর্শ প্রেমের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই নব্বইয়ের দশকের প্রেমের ধরণ ও আজকের এই আধুনিক প্রেমের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করাই আমার মূল উদ্দেশ্য।
সেকালের প্রেম
সময়টা ছিলো নব্বইয়ের দশক। প্রযুক্তির ব্যবহার আজকের মতো ছিলোনা। ছিলোনা কোন স্যোসাল মিডিয়ার মাতামাতি। সেই সময় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও ছিলো অনেকটা রক্ষণশীল। প্রেমকে খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখা হতোনা। সেকালে কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়াটাও ছিলো খালি হাতে বাঘ শিকারের মতো সাহসী একটা ব্যাপার। সেকালে এলাকায় কেউ প্রেমে পড়লে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো। মানুষের আলোচনা বা সমালোচনায় এই প্রেমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। প্রেমিক নামের মানুষটিকে অন্যভাবে দেখা হতো, যেন সে বা তারা কোন এলিয়েন, ভিন্ন গ্রহে থেকে পৃথিবীতে এসেছে! কারো মাঝে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলে সেটা নিজেদের মধ্যে অতি গোপনেই রাখতো। কিন্তু হঠাৎ করে প্রেমের বিষয়টা মানুষের দৃষ্টিগোচর হলে সেটা রাষ্ট্র হতে খুব বেশি সময় লাগতোনা। এখন যেমন স্যোসাল মিডিয়ার কল্যানে যে কোন খবর মুহূত্বেই ভাইরাল হয়ে যায় সেই সময়েও সমাজের কিছু মানুষ স্যোসাল মিডিয়ার ভূমিকা পালন করতো। প্রেমের বিষয়টা জানাজানি হওয়ার পরে প্রেমিক দম্পতিরা সমালোচিত হতো এবং সামাজিকভাবে হয়রানির শিকারও হতো। সমাজের ধারার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবারগুলোও ছিল রক্ষণশীল। অধিকাংশ পরিবারই প্রেমের সম্পর্ককে মেনে নিতো না, তারা এটিকে পরিবারের জন্য কলঙ্ক ও অপমানজনক বলে মনে করতো। এই কারণে দুজনের মাঝে মনের মিল এবং অনেক জোড়ালো ও আদর্শ প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও বা তারা দুজন দুজনের উপযুক্ত যোগ্য ও মানাসই থাকলেও পারিবারিক অসম্মতির কারনে প্রেম বিচ্ছেদে রূপ নিতো। তাই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া প্রেমিকজুটির কোনো বিকল্প উপায় ছিলনা আবার পালিয়ে যাওয়ার মতো সাহসও অনেকের মধ্যে ছিলোনা। তাছাড়া পালিয়ে যেখানেই যাবে সেখানেও সামাজিক বাধা বিপত্তি ছিলো। আজকের দিনের মতো এই ব্যাপারে সাহায্য করার মতো মানুষের খুব অভাব ছিলো তখন। এটা সত্য যে নব্বইয়ের দশকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে ভালোবাসা ছিল অনেক গভীর, কিন্তু তারা শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হলেও সামাজিক ও পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতার অভাবে সর্বোচ্চ ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে রূপ নিতো।
এই আধুনিক সহজলভ্য যুগেও মানুষ নব্বই দশকের প্রেমের উদাহরণ দেয়। নব্বইয়ের দশকের প্রেম হলো ঐতিহ্যবাহী প্রেম। সে সময়ের প্রেমের গল্প আজও মানুষের মনকে নাড়া দেয়। সে সময় প্রেমের উপর প্রযুক্তির প্রভাব ছিলোনা। ছিলোনা তেমন উন্নত সামাজিক যোগাযোগের ব্যবস্থা, টেলিফোন আর চিঠি ছাড়া যোগাযোগের আর কোন মাধ্যম ছিল না। টেলিফোনও ব্যবহারও সবার সামর্থে ছিলোনা, শুধুই শহর কেন্দ্রিক ধনী পরিবারই টেলিফোন ব্যবহার করতো। বলতে গেলে চিঠিই ছিলো সেকালে প্রেমের যোগাযোগের সেরা মাধ্যম। প্রেম আদান প্রদান হতো চিঠিতে রোমান্টিক প্রেমের মেসেজ পাঠিয়ে। এখনকার মতো পার্ক, বন্ধুর ফ্লাট বা বাড়ীতে বসে টাইমপাস করার কোন সুযোগ ছিলোনা। মূলত এমন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনেই একদম অপরিচিত দুজনের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো খুব কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচিত বা পরিচিতের পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন, আত্মীয়ের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, প্রতিবেশী ইত্যাদির মধ্যেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠতো। যে কারনে প্রেমিকজুটি একে অপরের সম্পর্কে জানা-শোনার যথেষ্টই সুযোগ ছিলো, আর তাই তাদের মধ্যে মনের মিল, আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং রোমান্স অনেক জোড়ালো হতো। প্রেমিকজুটির মধ্যে যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা থাকার কারনে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ ও আবেগ বেশি তৈরি হতো। আজো সেকালের রোমান্টিক প্রেমের গান শুনলে সেকালের প্রেমের গভীরতা ও প্রেমিকজুটির আবেগ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সেকালে প্রেম একদমই সহজলভ্য ছিলোনা, যার কারনে প্রেমিকের মনে এর মূল্যায়ন ছিলো খুব বেশি। একটা কমন সাইকোলজি বলা যেতে পারে- মানুষ সহজে পাওয়া কোন কিছুর চেয়ে কষ্ট করে পাওয়া জিনিসের মূল্যায়ন বেশি করে, এই উক্তিটি প্রেমের উক্তি না হলেও প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এই কথা খুব সহজেই অনুমেয় যে নব্বইয়ের দশকের প্রেম ভালোবাসা ছিলো এখনকার প্রেম ভালোবাসার চেয়েও অনেক বেশি রোমাঞ্চকর, গভীর অনুভূতিপূর্ণ এবং অতি মধুর। তবে দুঃখের বিষয় হলো সেকালের গভীর প্রেমগুলোর পরিণতি খুব বেশি পেতোনা রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারনে।
একালের প্রেম
এখন সময় বদলেছে, আজকে সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে সেই সাথে হয়েছে প্রেমের বিবর্তন। আজকাল প্রেমকে ঘৃণা হিসেবে দেখা হয় না। এখন প্রেমিকদের সমাজের ও পরিবারের রক্তচক্ষু আর দেখতে হয়না। প্রতিটি ঘরে ঘরেই যেন প্রেম চলে এসেছে। রাস্তাঘাটে, পার্কে, প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কেউ এখন ফিরেও তাকায় না। বেশির ভাগ পরিবারই খুশি মনে প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেয়। প্রেম এখন সহজলভ্য, চাইলেই পাওয়া যায়। এমনকি ক্লাস ফাইভের বাচ্চারাও এখন প্রেম করে স্যোসাল মিডিয়ার কল্যানে। আমরাও মেনে নেই, এতে আমাদের কোনো সমস্যাই হয়না। চারদিকে এতো প্রেমের ছড়াছড়ি কিন্তু প্রেমের পরিণতি সেই আগের মতোই আছে, তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রেমে সাফল্যের হার নব্বইয়ের দশকে যেমন ছিলো আজও আই আছে। প্রেমের বিবাহ তখনকার মতো খুব কমই চোখে পড়ে। অথচ এমনটি হবার কথা নয়। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেকেলে রক্ষণশীল সমাজ বা পরিবার এখন উদার হয়ে উঠেছে যা প্রেমের পরিণতির জন্য সহায়ক। তবুও প্রেমের পরিণতির হার আগের মতোই কেন?
আসলে সমাজ বা পরিবারের পাশাপাশি বদলে গেছে প্রেমের ধরণ। দুই যুগের প্রেমের পার্থক্য যেন আকাশ-পাতাল। বর্তমানে প্রেমের আদর্শগত পরিবর্তন ও সহজলভ্যতার কারণে এর গভীরতা কমে গেছে। প্রেমিকজুটির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক খুব শক্তিশালী নয়, ভালোবাসার বন্ধন আগের মতো মজবুত হয়না। বর্তমান প্রেম কিছুদিন পরে একঘেয়ে হয়ে যায় এবং ঠুনকো, অতি তুচ্ছ কারনেই প্রেম বিচ্ছেদে বা ব্রেকআপে পরিণত হয়। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার বন্ধন আগের মতো দৃঢ় নয়। দুজনেই একে অপরকে ঠিকভাবে চিনতে পারার আগেই এরা প্রেমে জড়িয়ে পরে তাই দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুবই কম থাকে তাই প্রেমের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে যায়, বিচ্ছেদ প্রেমের দরজায় কড়া নাড়ে। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদেই প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। এখনকার প্রেম ক্ষণস্থায়ী, যার শুরু হয় হাই হ্যালো দিয়ে কিছুদিন পর প্রেমের সমাপ্তি হয় ব্লক দিয়ে। প্রেমের উপর সামাজিক মিডিয়ার প্রভাবে প্রেম তার বৈচিত্র ও সৌন্দর্য্য হারিয়েছে। বর্তমানে প্রেমের প্রতি বর্তমান সমাজ বা পরিবার উদারপন্থি হলেও প্রেমিকজুটির দুর্বল ভালোবাসার বন্ধনের কারনে প্রেম অবশেষে বিচ্ছেদে রূপ নেয়।
উপসংহার
প্রেমের বিবর্তনের উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সহজভাবে বলা যায়- সেকালের প্রেম ছিলো আবেগ, অনুভূতিপূর্ণ আর ভালোবাসা ছিলো অনেক গভীর ও জোড়ালো কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারনে প্রেমের সম্পর্ক ধংস হয়ে যেতো আর কালের প্রেম তুলনামূকভাবে আবেগহীন, কোন সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা নেই কিন্তু আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা কম থাকার কারনে প্রেমের সম্পর্ক ধংস হয়ে যায়।
0 Comments