প্রেম ও বিচ্ছেদ
প্রেম ও বিচ্ছেদের এর সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট নিয়ে আজকের আলোচনা। অনেক কবি সাহিত্যিক প্রেমের কবিতা লিখেছে, প্রেমের গান লিখেছে, কেউবা প্রেমের গল্প বা প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন। আমি প্রেমের সাইকোলজি বা প্রেমের মনোবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। আমরা জানার চেষ্টা করবো প্রেম ও বিচ্ছেদ কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত করে?
প্রেম ও বিচ্ছেদ। Photo by Pixabay |
বর্তমান যুগের প্রেম যেন পদ্ম পাতার জল, এর কোন স্থায়ীত্ব নেই। হাতে গোনা এবং খুব ভাগ্যবান প্রেমিক প্রেমিকা জুটির প্রেম পূর্ণতা পায়। অপূর্ণতা প্রাপ্ত প্রেম বা ব্যর্থ প্রেম বা বিচ্ছেদ প্রায় পুরোটাই ফেইসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক। এই মিডিয়াগুলোতে আজকাল বিচ্ছেদের মানসিক প্রভাব ও সম্পর্ক ভাঙ্গা বা হৃদয় ভাঙ্গার কারনে পরিবর্তীতে হঠাৎ সাধুতে পরিণত হওয়া মানুষের স্যোসাল মিডিয়ার ওয়ালে হাদীস সহ অন্যান্য জীবনমুখী ধর্মীয় গ্রন্থের বাণী বেশ লক্ষণীয়। আমাদের সমাজের জন্য বেশ ভালো হতো যদি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সাধু সাজার ভান না করে মন থেকে সাধু হতো। প্রেম নিয়ে কবিতা তো আর কম লেখা হলোনা, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন আর প্রেমে পড়া বারণ নয়, প্রেম এখন খুবই সহজলভ্য। বর্তমানে প্রেমের ধারা বদলে গেছে কেউ আর দেবদাস হয়না, এক প্রেম গেলে আবার প্রেম চলে আসে এ ধারা বারোমাস ধরেই চলতে থাকে। চারিদিকে প্রেমের উপযুক্ত পরিবেশ তবুও অধিকাংশ প্রেম বিচ্ছেদে রূপ নেয়ার কারন কি? প্রেম ও বিচ্ছেদ সাইকোলজিটাই বা কি? চলুন দেখা যাক কেন বর্তমানে অধিকাংশ প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে এবং সম্পর্কের সমস্যার সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট কি?
প্রেম শুরু
আগের দিনে সোস্যাল মিডিয়া ছিলোনা তাই প্রেম হতো মোটামুটি পরিচিত, রেফারেন্সের মাধ্যমে পরিচিত, আত্মীয়, বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু, সামাজিক কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, স্কুল-কলেজের মাধ্যমে ও অন্যান্য পড়াশুনা রিলেটেড মাধ্যমে। দেখাশোনা, জানাশোনার পর ভালোলাগা তারপর প্রেম সংঘটিত হতো তাতে প্রতারণা, বাটপারি বা ছলনার সুযোগ তেমনটা ছিলোনা। প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে যোগাযোগ হতো প্রেমপত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে। এই প্রেমের চিঠি ছিলো দুজনের প্রেমের শক্তিশালী বন্ধন। তবুও আগের দিনের প্রেমে এখনকার চেয়ে ভালোবাসা ও আবেগের মাত্রা বেশি ছিলো, বিরহ ছিলো অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আর এখনকার প্রেমে আবেগ ভালোবাসার চেয়ে যৌন আকর্ষনের মাত্রা বেশি।
এখন প্রেমের মানসিক প্রভাব আগের মতো নেই, অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এখনকার সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সংঘটিত প্রেমে চেনা নেই, জানা নেই, দেখা নেই শুধু হাই-হ্যালোর ২-৩ দিন চ্যাটিং, ছবি আদান প্রদান (সেটা ফেইকও হতে পারে), ২-১ মিনিটের ভয়েজ কল- শুরু হয়ে গেলো প্রেম। কাউকে পটানোর জন্য তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়না। এরা যেন অর্ধেক তৈরিই থাকে প্রেমে পড়ার জন্য বাকিটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রেমের শুরুটা হয় ঝড়ের গতিতে। কারো সম্পর্কে তেমন কিছু জানার প্রয়োজন নেই, বোঝার প্রয়োজন নেই, দেখারও প্রয়োজন নেই শুধু চ্যাটিংয়ের অল্প একটু মিষ্টি কথাতেই প্রেমে শুরু হয়ে যায়। স্যোসাল মিডিয়া প্রোফাইলে দুই একটা প্রেমের স্ট্যাটাস বা প্রেমের উক্তি পোস্ট করলেই প্রেমিক বা প্রেমিকা পেতে কোন সমস্যা হয়না। এখন আর প্রেমিক প্রেমিকা খুঁজে বেড়াতে হয়না, অটোমেটিক একে অপরের কাছে চলে আসে। তাদের প্রেমে আবেগ ভালোবাসা সেট হয় প্রেম শুরু করার পরে। তারা জানেই না বা জানতেও চায়না প্রেম কি? ভালোবাসা কি? তাদের কাছে প্রেম হলো চ্যাটিং আর ডেটিং। তাদের প্রেমে কোন ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়না, তাদের প্রেমের কথায় আবেগ ভালোবাসার চেয়ে অন্যকিছুতেই আগ্রহ বেশি লক্ষ করা যায়।
বিচ্ছেদ
খুব সহজে কোন কিছু পেলে সেটার প্রতি গুরুত্ব, আন্তরিকতা, টান এবং মূল্যায়ন কম থাকে এটা শুধু প্রেমের ক্ষেত্রে নয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমানের প্রেম পূর্ণতা পায়না এই কারনেই। খুব সহজেই প্রেম হয়ে যাওয়াতে কেউ কারো মনের গভীর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা। প্রেমিক প্রেমিকার মনে আবেগ, ভালোবাসা তেমন জোড়ালো হয়না তবে যৌন আকর্ষনের ইচ্ছাটা প্রবলভাবেই থাকে। তাছাড়া এখন একজন মানুষের সাথে আরেকজনের কম্পেয়ার বা তুলনা করা যায় খুব সহজেই। তাই প্রেমিকজুটি বেটার গুণ সম্পন্ন অন্য কারো খোঁজও পেয়ে যায় আর নিজেদের মধ্যে আবেগ ভালোবাসা কম থাকে বলে বেটার অপশনের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়। এখান থেকে দুজনের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয় যা ধীরে ধীরে একসময় বিচ্ছেদে রুপ নেয়। আবার যেহেতু ম্যাক্সিমাম প্রেমের শুরু স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমেই তাই তাদের মধ্যে জানাশোনা ও বোঝাপড়াও কম থাকে। আর তাই হাই হ্যালো দিয়ে শুরু করা প্রেমের সম্পর্ক এক নিমিষেই ব্লকের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়।
সাইকোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট অফ লভ অ্যান্ড ব্রেকআপ
মনোবিজ্ঞানীরা সম্পর্কের সাইকোলজিক্যাল প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন এবং প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ দিলেও কিছু ক্ষেত্রে তারা একমত পোষণ করেছেন। একটা সূস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী কেমন হবে তার অস্পষ্ট একটা ছবি মনের ভিতর একে নেয় এবং জীবনসঙ্গীর গুণাবলী কেমন হবে এটাও মোটামুটি ঠিক করে নেয়। পরবর্তীতে কোন একসময় হঠাৎ কারো সাথে মনে আঁকা ছবি ও গুণাবলীর মিলে গেলে ভালোলাগা শুরু হয় এবং একটা প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেহেতু আগেকার দিনের মানুষের প্রেমে মনের চাহিদার সাথে সিলেকটেড হবু সঙ্গীর বৈশিষ্ট্যগুলো ম্যাচিং করার সুযোগ ও সম্ভাবনা বেশি ছিলো তাই তাদের প্রেমের মধ্যে বোঝাপড়া ও বন্ডিং অনেক শক্তিশালী হতো, প্রেম পূর্ণতাও পেতো এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোন সমস্যা সৃষ্টি হতোনা। বিচ্ছেদ বা ব্রেকআপ যে ছিলোনা সেটা বলা ভুল হবে, ব্রেকআপও ছিলো তবে বোঝাপড়া বা ভুল বোঝাবুঝির কারনের চেয়ে পারিবারিক বা সামাজিক কারনটাই ছিলো মুখ্য। আর তাদের বিচ্ছেদ বা ব্রেকআপের যন্ত্রনাও ছিলো অত্যন্ত তীব্র।
আর বর্তমানের সোস্যাল মিডিয়াভিত্তিক প্রেমের ক্ষেত্রে ফেইক ছবি, ফেইক নাম, ফেইক ঠিকানা, ফেইক পোস্ট ইত্যাদির মাঝে দুই একজনের সাথে একটু ভালো রিলেশনশিপ তৈরি হলেই একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় শুধুমাত্র ২-৩ দিনের চ্যাটিং বা ২-১ বার ভয়েজ কলের মাধ্যমে। এতে কোন রকম প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর গুরুত্ব পায়না এমনকি প্রেমের পূর্বে মনের চাহিদার সাথে ম্যাচিং করার সুযোগ হয়না। ম্যাচিং করার সুযোগ হয় প্রেমের পরে। তখন দেখা যায় তার মনে যে ছবি আঁকা ছিলো সেটার সাথে সঙ্গীর মিল কম ও ক্যারেকটারের সাথেও অমিল অনেকটাই। এক্ষেত্রে ঐ জুটির মনে "ধুর চাইলাম কি? আর পেলাম কি? এমন একটা অপ্রকাশিত অনুভূতি মনের ভিতরে চলে আসে এবং মন থেকে ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে শুরু করে। একটা সময় বিচ্ছেদ বা ব্রেকআপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। তবে বিচ্ছেদ কিন্তু প্রেমের মতো হুট করে সংঘটিত হয়না। এর জন্য জুটির কোন একজন ফেইক পরিস্থিতি তৈরি করে এবং যেকোন একটা অগুরুত্বপূর্ণ বা না গুরুত্ত্ব দিলেও পারতো এমন অজুহাতের মাধ্যমে একতরফাভাবে বিচ্ছেদ বা ব্রেকআপ ঘটানো হয়। এর মধ্যেই হয়তো কোন একজন প্রেমটাকে সিরিয়াসলিই ভাবে এবং পূর্ণতা পাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংঙ্গীর অনিচ্ছার কারনে বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে হতাশায় ও মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে না পেরে কষ্টের সাগরে নিমজ্জিত হয়। বিচ্ছেদ এবং মানসিক সুস্থতা এই দুইয়ের মাঝে একটি সূক্ষ্ণ সম্পর্ক আছে। সাইকোলজিক্যাল প্রভাব প্রেম বিচ্ছেদ এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই প্রভাবের কারনে প্রেমে যেমন ভালোলাগা সৃষ্টি হয় তেমনি বিচ্ছেদে সীমাহীন কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণাবোধ হয়, এটাই প্রেম ও বিচ্ছেদের বিজ্ঞান। আর বিচ্ছেদের এই যন্ত্রণা খুব সহজেই নিরাময় যোগ্য নয় তাই পরববর্তিতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি নেগেটিভ ধারনা পোষণ করে আর সোস্যাল মিডিয়াতে দুঃখজনক স্ট্যাটাস ও নীতিবাক্যের ঝড় তোলে। বিচ্ছেদের মানসিক স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় অনেকেই সামলে উঠতে পারেনা, তাই বিভিন্ন থেরাপি ও অন্যান্য মানসিক চিকিৎসা নিতে হয়। আবার কেউ হয়তো পুরো প্রেমঘটিত ব্যাপারটা (প্রাপ্তবযস্ক চ্যাটিং, কল, ভিডিও, ডেটিং) খুব এনজয় করে আবার পূর্ণ উদ্যমে নতুন করে শুরু নতুন প্রেমের মিশন শুরু করে। এই হলো বর্তমান যুগের প্রেম ও বিচ্ছেদের মানসিক অবস্থা।
উপসংহার
পরিশেষে এটাই বলবো- প্রেম করতে চাইলে আগের যুগের পন্থা অবলম্বন করুন বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের প্রেমের সম্পর্কের মতো। আর সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কাউকে ভালো লেগে গেলে প্রথমে বন্ধুত্ব করুন তারপর আর সাখে দেখা করুন, তার আচার আচরণ, চরিত্র, লাইফস্টাইল, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপক খোঁজখবর নিয়ে প্রেমের পথে পা বাড়ান। খোঁজখবর না নিয়ে, দেখা না করে কারো সাথে অন্তত প্রেমের সম্পর্কে জড়াবেন না। না দেখেই, না জেনেই তোমাকে ভালোবাসি বলা বন্ধুটি- আপনি হয় ভন্ড প্রেমিক নয়তো অতি আবেগী, বিচ্ছেদ বা ছ্যাকা খাওয়ার জন্যই সৃষ্ট খুবই সহজ-সরল একজন আদর্শ প্রেমিক বা প্রেমিকা।
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments