Feriwala - Inspiring Heart and Lives

Header Ads Widget

নারী কিসে আটকায়ঃ সম্পর্কের সমস্যাগুলি ও সমাধান

নারী কিসে আটকায়?

কিছুদিন যাবৎ এই প্রশ্নটি স্যোসাল সাইটে খুব আলোচিত হচ্ছে। কথাটা ট্রল হিসেবে শুরু হলেও এই বিষয়ে অনেকেই সিরিয়াস। নারী কিসে আটকায় এই প্রশ্নটি মূলতঃ বিবাহীত নারী সমাজকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। বিষয়টি এমন যে নারী এতোকিছু পেয়েও সংসারের মায়ায় আটকা না পড়ে বিচ্ছেদ ঘটায় কোন কারনে? তাই অনেকেই অবাক হয়ে উক্ত প্রশ্নটি বিদ্রুপ সাথেই করেছেন। সম্প্রতি কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর বিবাহ বিচ্ছেদের পর বিষয়টি স্যোসাল মিডিয়াতে ভাইরাল একটি টপিক। নারী আসলে কিসে আটকায় প্রশ্নে আমার চিন্তাভাবনা একটু অন্যরকম। এখানে শুধু নারীর আটকানের প্রশ্ন কেন? পুরুষের কি ভূমিকা নাই? একটা বিচ্ছেদের ঘটনা কি শুধু নারীর কারনেই ঘটে? পুরুষের কি কোন দায় বা দোষ নেই? এরকম কিছু প্রশ্নের সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট নিয়ে সাজিয়েছি আজকের টপিক।

ডিভোর্স (Divorce)
ডিভোর্স (Divorce) by Pexels.com



নারী কিসে আটকায় এর উত্তর

নারী কিসে আটকায় এই প্রশ্নের সহজ একটি উত্তর দিচ্ছি। উত্তর টা যাদের মনে এই প্রশ্ন তাদের জন্য। এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে আপনি নারী বলতে চিন্তা করেছেন আপনার ফ্যামিলির বাইরের নারীদের। নিজের ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনার মা, বোন ও স্ত্রী কিসে আটকিয়ে আছে? এখানেই সব উত্তর খুঁজে পাবেন। আপনার মা একজন নারী, তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও আপনার সংসারের প্রতি ভালোবাসা, পরিবারের সদস্যের প্রতি টান, দায়ীত্ববোধ ও নিজের পরিচয়, নিজের ঠিকানার জন্য আটকে আছে। আপনার বোন ও কন্যাও তাই, তারা অন্যের সংসারে গিয়ে সেই একই কারনে আটকে আছে। আপনার স্ত্রীও কেন আটকে আছে, এটা আপনার চেয়ে বেশি কেউ জানেনা। আশাকরি এরচেয়ে বেশি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকালে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। যে নারী কোন কিছুতেই আটকায় না, সে নারী প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বাধ্য হয় বন্ধন ছিঁড়ে চলে যেতে। ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে পুরুষরাই বাধ্য করে নারীদের। আরো কিছু সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার আছে। শুধু নারী সাধু, পুরুষ চোর ব্যাপারটা আসলে এরকম না, নারী বা পুরুষ কিছু কমন বিষয়ে আটকে যায়। এই কমন বিষয়গুলোর শূণ্যতার কারনে অনেক সময় বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। আবার নিজের দূর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে, অনেক না পাওয়ার আক্ষেপ মনের কোনে কবর দিয়ে অনেকেই কোনরকমে আজীবন আটকে থাকে। আসলে নারী জীবনসঙ্গী ও সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধ, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, বিকল্প ঠিকানার অভাব, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, নারীর পরিচয়ের অভাব ও সামাজিক নিরাপত্তায় আটকায়।


নারী কেন আটকায়?

মূলতঃ চারটি প্রধান কারনে নারী আটকে থাকে। কারনগুলো হলো- ১. জীবনসঙ্গী ও সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধ ২. সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ৩. বিকল্প ঠিকানার অভাব ৪. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ৫. সামাজিক নিরাপত্তা ও ৬.নারীর পরিচয়।


১. জীবনসঙ্গী ও সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধ

জীবনসঙ্গী ও সংসার, দুটি শব্দ যা একসঙ্গে জীবনের এক গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। নারী, এই সম্পর্কের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে, বিভিন্ন দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করে। তিনি একজন স্ত্রী, একজন মা, একজন ঘরের মনিষী, একজন সঙ্গী। এই সবগুলো ভূমিকা একসঙ্গে মিলে নারীর জীবনে একটি জটিল ও গভীর অর্থ সৃষ্টি করে। তিনি একজন স্বামীর সঙ্গী হিসেবে তার স্বামীকে সমর্থন করেন, তার সন্তানদের লালন-পালন করেন, এবং পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং তার পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য সবসময় কাজ করেন। এই দায়ীত্ববোধ তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করেন এবং পরিবারের সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীরা তাদের সংসার ও জীবনসঙ্গীর প্রতি এই দায়ীত্ববোধের মাধ্যমে সমর্থন ও স্থিতিশীলতা প্রদান করেন, যা পারিবারিক সুখ ও শান্তির জন্য অপরিহার্য।


অপরদিকে, এই দায়ীত্ববোধ কখনও কখনও নারীদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও স্বপ্ন পূরণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সংসারের প্রতি অতিরিক্ত দায়ীত্ব পালন করার ফলে নারীদের পেশাগত সুযোগ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আসতে পারে। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার বঞ্চিত হলেও, সংসার ও পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ববোধ অটুট থাকে। নারীরা অনেক সময় এই দায়িত্বকে নিজেদের পরিচয়ের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এটি তাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। নারীরা তার জীবনসঙ্গী, সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধ, তার কর্মজীবন এবং পরিবার জীবনকে সুন্দরভাবে সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। এই সমন্বয় সত্যিই একটি কঠিন কাজ, কিন্তু নারীরা এই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করছেন। এখানে নারী জীবনসঙ্গী ও সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধে আটকায়।


২। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা

অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা নারীকে আটকে দেয়। নারী সংসারের নিষ্ঠুর অত্যাচার, অবহেলা ও নানা অন্যায় আচরণ সহ্য করে শুধু সন্তানের কল্যান কামনায়। সন্তানের মুখ চেয়ে নিজের সুখ, হাসি বিসর্জন দিতে পারে সে হলো নারী। সন্তানের প্রতি নারীর ভালোবাসার উপস্থাপনা সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা দেয় ও তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, তাতে নারী স্বাধীনতা ও নারীদের অধিকার খর্ব হলেও সে খুব সহজেই মেনে নেয়। তাছাড়া নারী সন্তানের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। তাই কোন মা চায়না তার সন্তান অভাব-অনটন, অশান্তি, অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় হোক। এই কারনে নারী নিজের জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে হলেও সূস্থ্য বা অসূস্থ্য যাই হোক না কেন ঐ সংসারেই সে আটকে থাকে আজীবন। এখানে নারী সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় আটকায়।


৩। বিকল্প ঠিকানার অভাব

নারী তার অসূস্থ্য সংসারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উপযোগী অন্যকোথাও নতুন ঠিকানায় জীবন শুরু করতে পারে, কিন্তু এই সুযোগ ও সুবিধা অনেক নারীর ক্ষেত্রেই থাকেনা। নারীরা বিকল্প হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবার ঠিকানা বেছে নেয়। কিন্তু সেই ঠিকানাতেও নারীদের সমস্যা হতে পারে। যদি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাজনিত ও অন্যান্য সাংসারিক ঝামেলা উপস্থিত থাকে তাহলে আর সেই ঠিকানার উপর আস্থা থাকেনা। আবার বিভিন্ন কারনে নারীর বাবা-মা বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরাও অনেক সময় চায়না যে, নারী সংসার থেকে বের হয়ে আসুক। এই সমস্ত বিষয় চিন্তা করে নারী কষ্ট হলেও নিজের সংসারের ঠিকানাতেই থাকা নিরাপদ বলে মনে করে। তাই হাজারো সমস্যার মধ্যেও নারী আগের ঠিকানাতেই আটকে থাকে। এখানে নারী ঠিকানায় আটকায়।


৪। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারনে অধিকাংশ নারীই সাংসারিক কাজেই নিযুক্ত হয়। ইনকাম জেনারেট করতে পারে এমন কোন কাজ মূলত পুরুষরাই করে। অর্থনৈতিকভাবে নারীর বাধা একটা কমন বিষয়। সেক্ষেত্রে পুরুষের উপরই নারীরা অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই সমস্যার কারন হলো- আমাদের সমাজে বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীদের ছেলেবেলা থেকেই ব্রেইনে সেট করে দেয়া হয় যে, তাদের বৈবাহিক জীবন শুধু সাংসারিক কাজ, স্বামী-সন্তানের প্রতি দায়ীত্বপালন করা। সাংসারিক কাজই ভব্যিষতের একমাত্র লক্ষ্য তাই তাদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়না, কোন চাকরি বা অন্যকোন কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার মতো কোন কিছু তাদের শিখানো হয়না। তাই একজন বিবাহীত নারী সংসার থেকে বের হয়ে মুক্ত হতে পারবে ঠিক কিন্তু অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা মিটবে কিভাবে? অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হতে পারার কারনে নারী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেনা বরং নারী সমস্যার মুখোমুখি হয়। এরচেয়ে সে সংসারেই থাকা ভালো মনে করে কারন আর যাই হোক টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন হয়না। এইসব চিন্তা করেই নারী সংসারে আটকে থাকে। এখানে নারী অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় আটকায়।



৫। সামাজিক নিরাপত্তা

নারী সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলে সমাজ তাকে আগের মতো মূল্যায়ণ করেনা। যতই নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলিনা কেন সাংসারিক ঝামেলাতে নারীর কোন দোষ বা অবদান না থাকলেও সমাজ নারীর দিকেই আঙ্গুল তোলে। নারীর চরিত্র নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলে। আসলে একজন নারীকে খুব সহজেই দোষারূপ করা যায়, যে কেউ ইচ্ছা করলেই একজন নারীর নামে স্ক্যান্ডাল ছড়াতে পারে তাতে কোন তথ্য প্রমাণ দেয়ার প্রয়োজন হয়না। আর এই স্ক্যান্ডাল বিনা বিচারে, বিনা বিবেচনায় ৫০% লোক বিশ্বাস করে। এই কারনে সংসার ভাঙ্গার দোষের প্রায় সবটুকুই নারীর উপরে যায়। পরবর্তিতে ঐ নারী এই স্ক্যান্ডাল থেকে মুক্ত হতে পারেনা, সমাজে সে নারী নিজেকে অনিরাপদ বোধ করে। সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নারী সংসার থেকে নিজেকে মুক্ত না করে ঐ সংসারেই আটকে থাকে। এখানে নারী সামাজিক নিরাপত্তায় আটকায়।


৬. নারীর পরিচয়

আমাদের সমাজে নারীর পরিচয়ে বিভিন্ন বাধা রয়েছে যা নারী অধিকার এবং তাদের সঠিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। প্রথমত, বৈষম্য এবং পুরানো ধ্যানধারণার প্রভাব নারীদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনে উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। সমাজে এখনও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে নারীদের কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা, এবং নেতৃত্বের সুযোগ সীমিত থাকে। পুরানো সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ধারণাগুলি নারীদের ক্ষমতা ও সুযোগের পরিধি সংকুচিত করে, যা নারী উন্নয়ন, নারী সবলীকরণ এবং তাদের আত্মনির্ভরশীলতার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে, পারিবারিক দায়িত্ব এবং নিরাপত্তাহীনতার মতো চ্যালেঞ্জও নারীদের পরিচয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে। নারীদেরকে প্রায়ই নির্দিষ্ট ভূমিকায় আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়, যেমন গৃহকর্ম এবং সন্তান লালন-পালন, যা তাদের পেশাগত উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা দেয়। তাদেরকে পুরুষদের তুলনায় কম সক্ষম বলে মনে করা হয় এবং তাদের কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করার সুযোগ কম দেওয়া হয়। পাশাপাশি, নারীদেরকে প্রায়ই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের মতো নিরাপত্তাহীনতার অভিজ্ঞতাগুলি তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজে নারীদেরকে পুরুষদের অধীনস্থ বলে মনে করা হয় এবং তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত থাকে, যা নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে। অধিকাংশ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাই, রাষ্ট্রিয়, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলি নারীদের উপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে নারীদের উন্নতির বাধা হিসেবে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। ফলে, নারীরা প্রায়শই বিয়ের পূর্বে পিতার পরিচয়ে এবং বিয়ের পরে স্বামীর পরিচয়ে নিজেদেরকে পরিচয় হারিয়ে ফেলে। এখানে নারী নিজের পরিচয়ে আটকায়।


উপরোক্ত কারনে নারী সংসারে আটকে থাকে। নারী কিসে আটকায় এর সারমর্ম হলোঃ নারী টাকা-পয়সা, গয়না, সম্পত্তি, ক্ষমতায় আটকায় না; নারী আসলে নিরাপত্তা, দায়ীত্ববোধ, আবেগ ও ভালোবাসায় আটকায়। তবে নারীর পেশাগত স্কিল থাকলে ও তার পৈতৃক স্ট্যাটাস উন্নত থাকলে সে সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পায় এবং বিকল্প ঠিকানারও অভাব থাকেনা। সেক্ষেত্রে নারী জীবনসঙ্গী ও সংসারের প্রতি দায়ীত্ববোধে আটকে থাকেনা তখন সে বিচ্ছেদকেই নিজের ও সন্তানের জন্য সার্বিকভাবে নিরাপদ মনে করে।


নারী (Women)
নারী (Women) by iranwire.com


নারী কেন আটকায়না? তারা কেন সংসার ছেড়ে চলে যায়?

নারী যখন সংসার ছেড়ে চলে যায়, এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে এবং প্রতিটি কাহিনী ভিন্ন। প্রথমত, নারীরা সংসার ছেড়ে যায় যখন তারা মানসিক, শারীরিক, বা আবেগিক নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক নারী তাদের জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে মানসিক, শারীরিক, বা আবেগিক নির্যাতন সহ্য করেন, যা ধীরে ধীরে তাদের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়াও, যখন নারীটি সম্পর্কের মধ্যে সমান অধিকার বা সম্মান পান না, অথবা তার মতামত এবং চাহিদাগুলো উপেক্ষা করা হয়, তখন সে নিজেকে অবমূল্যায়িত বোধ করে এবং সম্পর্কটি আর টিকিয়ে রাখতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে, নারীরা স্বাধীনতা বা নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে সংসার ছেড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অভাব, পারিবারিক দায়িত্বের চাপ, এবং সন্তুষ্টির অভাবও নারীকে সংসার ছাড়তে প্ররোচিত করতে পারে। যেমন, যখন সংসার বা পরিবার থেকে তার ওপর অসহনীয় দায়িত্ব এবং প্রত্যাশা চাপানো হয়, যা তার শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের বাইরে, তখন সে পালিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে। এছাড়া, যদি সংসারে তার পরিপূর্ণতা বা আনন্দের অভাব থাকে, এবং সে তার জীবনে অন্য কোনো দিক থেকে পূর্ণতা খোঁজে, যেমন ক্যারিয়ার, শিক্ষা বা নতুন সম্পর্ক, তখনও সে সংসার ছাড়তে পারে। এছাড়া, সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে, বা নিজের জীবনের উন্নতির জন্যও নারী সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে, আধুনিক সমাজে নারীদের স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী সবলীকরণের উপায়গুলো প্রয়োগের মাধ্যমে নারীরা পরিবার, সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে। তাই অনেক নারী নিজের স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণের জন্য, নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য বা নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, দুই সঙ্গীর মধ্যে মতবিরোধ, ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও মূল্যবোধের কারণেও বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটি নারীর সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণকে দায়ী করা যায় না। এটি একটি জটিল সমস্যা যার পেছনে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কারণ জড়িত থাকে। সাধারণত নারীরা সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হলোঃ

  • মানসিক যন্ত্রণাঃ দাম্পত্য জীবনে মানসিক যন্ত্রণা, অবসাদ, এবং চাপ অনেক নারীকে সংসার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে।
  • সঙ্গীর অবহেলাঃ স্বামীর অবহেলা, ভালোবাসার অভাব, এবং মনোযোগ না পাওয়াও একজন নারীকে সংসার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করতে পারে। 
  • পরকীয়াঃ নারী পরকীয়া প্রেমে জডিয়ে পড়লে সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে অথবা স্বামী পরকীয়ায় জড়ালে নারী এটা মেনে নিতে পারেনা তাই রাগে, দুঃখে ও অভিমানে সংসার ছেড়ে সে চলে যেতে পারে।
  • পারিবারিক নির্যাতনঃ পরিবারের সদস্য কর্তৃক শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী সংসার ছেড়ে চলে যায়।
  • শোষণঃ যখন একজন নারীকে তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন শোষণ করে, তখন সে নিজেকে বাঁচাতে সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে।
  • অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাঃ যখন একজন নারী আর্থিকভাবে নিরাপদ বোধ করে না, তখন সে নিজের এবং তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে।
  • স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের অভাবঃ অনেক নারী নিজের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যকে খুব গুরুত্ব দেয়। যখন তাদের এই অধিকারগুলি ক্ষুণ্ন হয়, তখন তারা সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে।
  • ক্যারিয়ারঃ শিক্ষিত এবং কর্মজীবী নারীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলে বা কেরিয়ার গঠনে বাঁধা পেলে সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে।


একজন নারী সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার আরো অনেক কারনই বলা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে প্রধান কারন হলো দাম্পত্য সমস্যা। যতই নারী সমস্যার সমাধান নিয়ে গবেষণা বা নারীকে সবলীকরণ করা হোক না কেন মূলতঃ দাম্পত্য সমস্যার কারনেই অন্যান্য সমস্যাগুলির সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে নারীদের উন্নয়নে অনেক সফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হলেও নারীকে সংসারে আটকে রাখার সূচক বাড়েনি বরং দিনদিন কমছে। তাই নারী-পুরুষের দাম্পত্য সমস্যা সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। সংসারে নারী-পুরুষের দাম্পত্য বোঝাপড়া ঠিক থাকলে নারী আজীবন আটকে থাকবে, কথনোই সে সংসার ছেড়ে চলে যাবেনা।



দাম্পত্য সমস্যা সমাধানে সাইকোলজিক্যাল পরামর্শ ও করণীয় 

দাম্পত্য সমস্যা একটি সাধারণ ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, আস্থা ও বোঝাপড়া কমে গেলে, যোগাযোগের ব্যবধান বাড়লে, অথবা অন্যান্য কারণে দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে। এই সমস্যাগুলো যদি সময়মতো সমাধান না করা হয়, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ভয়াবহ পরিণতি ঘটতে পারে।


সাইকোলজিক্যাল পরামর্শ এই ধরনের সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকর উপায়। সাইকোলজি মতে জীবনসঙ্গীর চাওয়া-পাওয়ার হেরফেরের কারনে দাম্পত্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। জীবনসঙ্গীর প্রতি নারী-পুরুষের চাওয়া সাধারণত একই রকমের। সঙ্গী এই চাওয়া বা আশাগুলোতেই একেঅপরের প্রতি আটকে থাকে। সঙ্গী নারী হোক বা পুরুষ সে সঙ্গীর কাছে আশা করে তার সাথে সঙ্গী নিম্নোক্ত কাজগুলো করুকঃ

  • তার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করুক।
  • তার ইচ্ছা, স্বপ্নকে সাপোর্ট করুক।
  • তার সাথে প্রশংসামূলক কথা বলুক।
  • তাকে পর্যাপ্ত সময় দিক।
  • তাকে গুরুত্ব ও সম্মান দিক, মূল্যায়ণ করুক।
  • প্রভু হিসেবে নয় বন্ধুর মতো আচরণ করুক।
  • মাঝেমাঝেই তাকে তার প্রিয় উপহার দিক।
  • ভালোবাসুক, আবেগ প্রকাশ করুক, মজার মজার কথা বলুক।
  • শারিরীক স্পর্শজনিত সুখ দিক।
  • বিশেষ সময়ে অ্যাকটিভ ও এগ্রেসিভ হোক। 


এই পয়েন্টগুলোর সবগুলো চাহিদা কারোর থাকেনা। বড়জোর ৪-৫ টা চাহিদা থাকে বা কারো ক্ষেত্রে একটু বেশি অথবা কম। আবার সবারই একরকম চাহিদা থাকেনা একেক জনের ক্ষেত্রে একেকরকম। এই চাহিদাগুলো নারী-পুরুষের জন্য কমন। একজন সঙ্গীর কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু কেউই চায়না। সাধারণত এই ১০টি চাহিদার বাইরে কারো চাহিদা থাকেনা, যদি থেকে থাকে তবে সেটা অস্বাভাবিক, উদ্দেশ্যমূলক, অন্যকোন স্বার্থের ব্যাপার আছে। চাহিদা বলতে টাকা, ক্ষমতা, স্মার্টনেস ইত্যাদি এগুলো বাজে কথা, যা শুধু ট্রল করার জন্য উপযুক্ত।


সঙ্গীর সিলেকটেড চাহিদাগুলো পূরণ না হলে তাদের মধ্যে ধীরেধীরে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সম্পর্কে অশান্তি সৃষ্টি হয়, সঙ্গী অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে বা পরকীয়ায় জড়াতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে কারনগুলো অতি সাধারণ বা ক্ষুদ্র মনে হলেও একসময় সেটা বড় আকার ধারন করে। সব বড় সমস্যা হঠাৎ করে শুরু হয়না, ছোট ছোট সমস্যা সময়ের সাথে বৃদ্ধি পেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করে। পুরুষ বা নারী সঙ্গীর একেঅপরের এই ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূরন করুন, নারী বা পুরুষ আজীবন একেঅপরের সাথে আটকে থাকবে। আমাদের মূল সমস্যা এখানে, আমরা আশাকরি সঙ্গী আমাদের চাহিদা পূরন করুক অথচ সঙ্গীর চাহিদা কি সেটার কোন মূল্যায়নই করিনা, জানতেও চাইনা, শুধু নিজের চাহিদাপূরন নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আবার এটাও মনে করি আমার চাহিদা যেরকম সঙ্গীরও একই রকম হবে। আসলে এই থিংকিংটা সম্পূর্ণ ভুল, কারন পৃথিবীর সবাই সতন্ত্র, সবারই আলাদা চাহিদা থাকে, ভালোলাগা থাকে, একজনের সাথে আরেকজনের মিল নাও হতে পারে। সঙ্গীর মনমানসিকতা ও চাহিদা সেইম হলে সে বিরল ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। এরকম মিল হয়তো লাখে একটা হতে পারে। তাই আপনার সঙ্গী আপনার মতো না, তার চাহিদা, ভালোলাগা অন্যরকম হবে এই থিংকিংটা মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নিয়ে দুজন দুজনের চাহিদা মেটান। তবেই দুজনেই একেঅপরের প্রতি চিরস্থায়ীভাবে আটকে থাকতে পারবেন। এরপর থেকে আটকে না থাকার দোষ শুধুমাত্র নারীকে দেয়ার আগে দুইবার ভাববেন। পুরুষের দোষেও নারী সংসারে আটকে না সংসার ছেড়ে চলে যায়। নারীকে আটকে রাখার পরিবেশ ও মনমানসিকতা সৃষ্টি করুন এবং নিজেও আটকে থাকুন।


উপসংহার

নারী কিসে আটকায় এই প্রশ্নের সমাধান আলোচনা হলো। যে ছয়টি কারন আলোচনা করা হলো এর বাইরে আরো অনেক কারন আছে তবে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। পরিশেষে এটাই বলতে চাই জীবনসঙ্গীর প্রতি দায়ীত্ব ঠিকমতো পালন করা হলে নারী ও পুরুষ দুজনেই আটকে থাকবে আজীবন। আর এই দায়ীত্ববোধ পালন করা না হলে কেউ আটকে থাকতে চাইবেনা, সঙ্গী ছেড়ে যেতে পারে। তবে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও ছেড়ে যেতে পারেনা, কারন ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে। পরিশেষে "নারী কিসে আটকায়?" এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে এটিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যার চেয়ে একটি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা বলাই সমীচিন।


Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments