একে-৪৭
একে-৪৭ (AK-47) রাইফেল হলো পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল ও আক্রমণাত্মক রাইফেলের মধ্যে একটি। এটি প্রায় ৭৭ বছর ধরে কার্যত অপরিবর্তিত সামরিক পরিষেবায় কাজ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গোপনে এটি তৈরি করেছিল। এটি অতিরিক্ত গরম হয়না, ভাঙ্গেনা এবং জ্যাম হয়না তাই খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান দখল করে। এটি ইউএসএসআর থেকে সবচেয়ে লাভজনক রপ্তানি। ৭৭ বছর পরেও এর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। এটি একটি সাংস্কৃতিক আইকন, প্রতীক এবং গর্বের উৎস হয়ে উঠেছে। এটি ২০ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি। এটি এমন একটি রাইফেল যা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অনুকরণ করা হয়েছে, যদিও অনেকে বলে যে এটি আসলটির সাথে তুলনা করা যায় না।
একে-৪৭ । Image by Wikimedia Commons |
একে-৪৭ এর ইতিহাস
একে-৪৭ (অ্যাভটোম্যাট কালাশনিকভা ১৯৪৭) সোভিয়েত প্রকৌশলী মিখাইল কালাশনিকভের দ্বারা ডিজাইন করা একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, যা ১৯৪৭ সালে উন্নত করা হয়। এটি সহজ ডিজাইন, টেকসই নির্মাণ এবং কার্যক্ষমতার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত ও ব্যবহৃত। এই রাইফেলটির ইতিহাস কয়েকটি ধাপে বর্ণনা করা যায়। ধাপগুলি নিম্নরূপ:
কালাশনিকোভ অ্যাসল্ট রাইফেল উদ্ভাবনের পটভূমি
একটি উন্নতমানের অ্যাসল্ট রাইফেলের প্রয়োজনীয়তা শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সেই সময়ে পদাতিক সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত বিভিন্ন কৌশলে সমস্যা সৃষ্টির কারন থেকে। ১৯৩৯ এবং ১৯৪০ সালের জার্মান ব্লিটজক্রেগ বিরোধী দেশগুলিকে তাদের কৌশল এবং সেইসাথে যুদ্ধে রাইফেলম্যানের স্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত পরিখাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পরে। এটি ছিল একটি নতুন সময়, যুদ্ধের একটি নতুন যুগ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে একটি ভাল লক্ষ্য এবং সময়মতো গুলি চালানো ব্যাকডেটেড বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নতুন এই সময়ে একজন সৈনিক এবং তার শত্রুর মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে, তাই দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে বড় ক্যালিবার বুলেট নিক্ষেপ করতে পারে এমন যুদ্ধের রাইফেলের আর প্রয়োজন ছিল না। নতুন এই যুদ্ধক্ষেত্রে, অনেক ছোট (পদাতিক পদে) এবং রাইফেলম্যান প্রতিপক্ষের অনেক কাছে, মুখোমুখি অবস্থনে ছিল। যুদ্ধের মতবাদের এই নাটকীয় পরিবর্তনের সুবিধার্থে একটি নতুন ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। এমন একটি প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োজন ছিল, যা হবে একটি যুদ্ধ রাইফেলের মতো মারাত্মক তবে এর পাল্লা হতে হবে স্বল্প থেকে মাঝারি লক্ষ্যগুলি যাতে টার্গেট করা যায়। সেই সময়ে বিভিন্ন ধরনের সাবমেশিনগানের ব্যবহার ছিল, কিন্তু তাদের ক্যালিবার তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল এবং সেগুলি যথেষ্ট সঠিক ছিল না। এমনকি প্রতিটি পদাতিক সৈন্যের জন্য একটি সাবমেশিনগান, অতিরিক্ত গোলাবারুদ, আনুষাঙ্গিক এবং ব্যক্তিগত গিয়ার বহন করাতে কিছুটা জটিলতা ছিল। তাই স্বতন্ত্র সৈনিককে একটি নতুন ধরনের রাইফেল সরবরাহ করা প্রয়োজন হয়ে। এ বিষয়টিকে জার্মানরা একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখেছিল। তারাই প্রথম এই ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং তারাই এটির উন্নয়নে প্রথম কাজ শুরু করে।
১৯৪৩ সালে, জার্মান অ্যাসল্ট রাইফেল, Sturmgewehr (StG 44 নামেও পরিচিত) উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এটি ছিল এই ধরণের প্রথম রাইফেল এবং এটিকে প্রথম আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেই সময়ে ব্যবহৃত যে কোনো সাবমেশিনগানের চেয়ে এটি নিরাপদ, সহজ এবং পরিচালনা করা সহজ ছিল। দুই বছর পরে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু জার্মান StG 44 তেমনভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। সোভিয়েতরা এই নতুন অস্ত্র StG 44 দেখে খুব মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়েছিল। বিশেষ করে একজন সোভিয়েত সৈনিক, যার নাম মিখাইল টিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। পরবর্তিতে যিনি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল একে-৪৭ আবিষ্কার করিছিলেন।
একে-৪৭ ও মিখাইল কালাশনিকভ
একে-৪৭ এর ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে সবার প্রথমেই এর আবিষ্কারক “মিখাইল টিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ”কে নিয়ে শুরু করতে হবে। মিখাইল টিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ (১৯১৯ - ২০১৩) ১৯৩৮ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি সাঁজোয়া বাহিনীর অংশ হিসাবে তার পরিষেবা শুরু করেছিলেন এবং ট্যাঙ্কের চাকা, গিয়ার, গ্রীস, ডিজেল এবং যন্ত্রপাতির দায়ীত্বে নিয়েজিত ছিলেন। তিনি সর্বদা যন্ত্রপাতি এবং প্রকৌশলের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহন ও বসবাসকারী, মিখাইলের যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে শিক্ষা অর্জন করার কোন উপায় ছিল না। সেনাবাহিনী তাকে তার আবেগ ও তার প্রযুক্তিগত দিক শিক্ষা এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ দিয়েছে। কালাশনিকভ সে সময় একটি ইঞ্জিনের অংশ ডিজাইন করেছিলেন যা উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই তরুণ সৈনিক এবং জেনারেল জর্জি জুকফের (যে ব্যক্তি পরে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে রেড আর্মিকে নেতৃত্ব দেন) মধ্যে একটি বৈঠক নির্ধারণ করেছিলেন। সেই বৈঠকের পর কালাশনিকভকে কিয়েভের টেকনিক্যাল আর্মোরি স্কুলে পাঠানো হয়। যখন তার স্কুলে পড়াশুনা চলছিল তখন কালাশনিকভ তার নতুন রাইফেলের ডিজাইন উন্নত করতে সক্ষম হন এবং আরও দুটি মডেল তৈরি করেন। যাইহোক, পরবর্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কালাশনিকভের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কালাশনিকভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে ব্রায়ানস্কের যুদ্ধের সময় মিখাইল কালাশনিকভ আহত হন। আঘাত থেকে সুস্থ হয়ে তিনি একটি নতুন ধরণের যুদ্ধ রাইফেলের পরিকল্পনা শুরু করেন যা একটি সাধারণ সৈনিকের রাইফেলের বহনযোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রচলিত দুই-ম্যান মেশিনগান সিস্টেমের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। ১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সালে শেষ হয়েছিল, কিন্তু কালাশনিকভ এই ধরনের একটি অস্ত্রের উন্নয়নে কাজ করতে থাকেন এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালে এটি তৈরি করেছিলেন যা এখন আইকনিক একে-৪৭। একে-৪৭ এর AK এর অর্থ হলো Avtomat Kalashnikov বা স্বয়ংক্রিয় কালাশনিকভ আর 47 অর্থ হলো যে বছর (১৯৪৭ সাল) এটি আনুষ্ঠানিকভাবে রেড আর্মির জন্য একটি নতুন অস্ত্র ব্যবস্থা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। কালাশনিকভ ডিজাইন যা বিশ্বব্যাপী "AK" নামে পরিচিত, এটি সহজ, মজবুত, নির্ভরযোগ্য, ভয়ঙ্কর মারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং লাভজনক।
মিখাইল কালাশনিকভ ছিলেন একজন বিনয়ী মানুষ। তিনি তার সমসাময়িক সহকর্মী রাশিয়ানদের দ্বারা সম্মানিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে, রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলতসিন কালাশনিকভকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং তাকে মাতৃভূমির বিশেষ পরিষেবার জন্য সম্মানিত করেন। তার অনেক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও মিখাইল কালাশনিকভ খুব ধনী ব্যক্তি ছিলেন না। যদিও তার আবিষ্কৃত অস্ত্র খুব বেশি প্রচলিত ছিল (এবং এখনও আছে) কিন্তু এর থেকে তিনি সামান্যই অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। তার আদর্শ ছিল দেশপ্রেম। অর্থনৈতিকভাবে লভের চিন্তা থেকে তিনি এই অস্ত্র তৈরি করেননি। তিনি সবসময় বলতেন যে তার রাইফেলটি দেশের প্রতিরক্ষার জন্য, আক্রমণের জন্য নয়। তিনি তার আগ্নেয়াস্ত্র এবং এর সরল ডিজাইন এবং নির্ভরযোগ্যতার জন্য গর্বিত ছিলেন এবং অস্ত্র তৈরির বিষয়ে কোনো দ্বিধা বোধ করেননি। কিন্তু পরবর্তিতে বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত বণ্টন নিয়ে কালাশনিকভ খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। কালাশনিকভ সহিংসতার আশ্রয় নেওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের অভিযুক্ত করেছিলেন। তার মতে, মানুষই অন্য মানুষকে হত্যা করে, অস্ত্র নয়। অস্ত্র হলো হাতিয়ার, যা তাদের চালনাকারীর আদেশ অনুসারে কাজ করে।
একে-৪৭ এর উৎপাদনের ইতিহাস ও বৈশ্বিক প্রভাব
একে-৪৭ রাইফেলের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। মিখাইল কালাশনিকভের রাইফেলের নকশাটি সেনাবাহিনী দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি নতুন এবং উন্নত নকশা হিসেবে অনুমোদিত হয়েছিল। এক বছর পরে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে কালাশনিকভ অ্যাভটোম্যাট (অ্যাসল্ট রাইফেল) মডেল ১৯৪৭ নামকরণ করা হয়েছিল। এটি ভবিষ্যতের সমস্ত রাশিয়ান ছোট অস্ত্রের প্রোটোটাইপ হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৯ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন গোপনে একে-৪৭ উৎপাদন শুরু করে। এটি ইজেভস্ক শহরে অবস্থিত একটি অস্ত্র কারখানায় উৎপদিত হয়েছিল। ইজেভস্ক জারদের সময় থেকে রাশিয়ান পদাতিকদের জন্য সরবরাহকারী এবং অস্ত্রাগার হিসাবে কাজ করেছিল। ১৯৫০ এর দশকে একে-৪৭ ফ্রন্ট লাইন সোভিয়েত পদাতিক অস্ত্র হয়ে ওঠে। যদিও কারখানাটি কিছু বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, তবে উৎপাদন অব্যাহত ছিল। সৈন্যরা নিজেরাই গোপনীয়তা রক্ষা করত। রাইফেলটি গুলি করার সময় এবং এটি দিয়ে প্রশিক্ষণের সময়, প্রতিটি বুলেটের খোসা সংগ্রহ করে রাখতো। একে-৪৭ পরিবহনের সময় একটি ব্যাগে ঢেকে রাখা হত। সোভিয়েতরা চায়নি যে কেউ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানুক এবং তাদের এই পরিকল্পনা ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিদ্রোহ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৫৯ সালে একে-৪৭, AKM-এর একটি নতুন সংস্করণ চালু করা হয়। এটি ছিল একে-৪৭ এর আধুনিক সংস্করণ এবং সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা মডেল। এর সমস্যাগুলি নতুন প্রযুক্তি দ্বারা সমাধান করা হয়েছিল, ধাতুকে শক্তিশালী করে রিসিভারের সমস্যাগুলি সংশোধন করা হয়েছিল এবং অস্ত্রটি অনেক হালকা এবং আরও সাশ্রয়ী করা হয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে বিশেষ করে চীনে AKM-এর উত্থান হতে দেখা যায়। বন্ধুত্বপূর্ণ এবং অ-বান্ধব দেশগুলোর হাতে ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ একে-৪৭ পৌছে গিয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকটি অনেক জায়গায় রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বিপ্লবের উত্থান ঘটে, সে সময় প্রায় সব সংগ্রাম বা বিপ্লবেই একে-৪৭ এর বিপুল সংখ্যক ব্যবহার হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে রাশিয়া ও চীন সমর্থিত উত্তর ভিয়েতনামের যোদ্ধারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবশিষ্ট অস্ত্র, দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্য এবং তাদের আমেরিকান উপদেষ্টাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যাপকহারে একে-৪৭ এর ব্যবহার করে এবং এখানেও একে-৪৭ এর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখে। সামরিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একে-৪৭ এর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করা যায়। শীতল যুদ্ধ ও পরবর্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে রাশিয়ার বড় বড় অস্ত্রগুলোর ডিমান্ড কমে যায় কিন্তু ছোট হাতিয়ার একে-৪৭ তার ঐতিহ্য ধরে রাখে।
একে ৪৭ রাইফেল এর জনপ্রিয়তা
একে-৪৭ এর ১০০ মিলিয়নেরও বেশি ইউনিট এবং এর অন্যান্য রূপগুলি ১৯৪৯ সাল থেকে ১০৬টিরও বেশি দেশে বৈধভাবে বিক্রি এবং/অথবা ব্যবহার করা হয়েছে। এই কারণে একে-৪৭ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে। একে-৪৭ এবং এর রূপগুলি অগণিত চলচ্চিত্র, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, ভিডিও গেম এবং অ্যানিমেটেড সিরিজে ব্যবহৃত হয়েছে। কালাশনিকভের কথাও বেশ কয়েকটি গানে উল্লেখ করা হয়েছে, ভদকার একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়েছে, এটির নামে একটি পানীয় তৈরি করা হয়েছে (ভদকা, লেবু, অ্যাবসিন্থ, দারুচিনি এবং চিনি) এবং এটি ব্যবহার করা হয়েছে অগণিত মানুষ শিল্প প্রকল্প এবং ইনস্টলেশনে।
সাদ্দাম হোসেনের বিশাল অস্ত্র সংগ্রহে একটি সোনার প্রলেপ দেওয়া কালাশনিকভ পাওয়া গেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ একে-৪৭ ব্যবহারের বড় একটি উদাহরন। ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী রাশিয়ার সহযোগিতায় একে-৪৭ কে মূল অ্যাসল্ট রাইফেল হিসেবে ব্যবহার করে। আফ্রিকান দেশগুলিতে এমন বাবা-মা আছেন যারা স্বাধীনতা, প্রতিরোধ এবং নিপীড়নকে জয় করার প্রতীক হিসাবে তাদের সন্তানের নাম রেখেছেন কালাশ। মিশর সিনাই উপদ্বীপে একে-৪৭ এর একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। রাশিয়াই একমাত্র দেশ ছিল না যেটি তার মুদ্রায় কালাশনিকভ বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিল। ২০০৭ সালে, নিউজিল্যান্ড একে-৪৭ এর আবিষ্কারের ৬০তম বার্ষিকীকে স্মরণ করার জন্য দুটি রৌপ্য মুদ্রার একটি বিশেষ সীমিত সংস্করণের সেটে অস্ত্র এবং এর স্রষ্টাকে মুদ্রিত করে। মোজাম্বিক জাতি এবং লেবাননের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ তাদের পতাকায় এই রাইফেল তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে এটি স্থাপন করেছে।
অন্য যেকোনো অ্যাসল্ট রাইফেলের তুলনায় একে-৪৭ এর দাম কত কম, তা সত্যিই বিস্ময়ের। বিশ্বের কিছু জায়গায় মাত্র ১০ ডলার থেকে ২০০ ডলার খরচ করলেই একটি একে-৪৭ কিনতে পারা যায়। তুলনামূলকভাবে একে-৪৭ এর দাম কম হওয়ার কারণে এটি রাস্তার গ্যাং, সন্ত্রাসী এবং গুন্ডাদের সবপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি সমস্ত ধরণের জাতিগত বা উপজাতীয় সহিংসতার প্রতীক এবং আফ্রিকাতে এটি খুব প্রচলিত। কালাশনিকভ রাইফেল প্রতি বছর আনুমানিক ২৫০,০০০ জন মানুষকে হত্যা করতে ব্যবহৃত হয়। একে-৪৭ যেকোনো সামরিক আগ্নেয়াস্ত্র, বিমান হামলা বা রকেট হামলার চেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটিয়েছে।
একে ৪৭ এর বৈশিষ্ট্য
একে-৪৭ রাইফেলটি সহজ নকশা, টেকসই নির্মাণ এবং কার্যক্ষমতার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এটি ৭.৬২×৩৯ মিমি গোলাবারুদ ব্যবহার করে এবং গ্যাস অপারেটেড রোটেটিং বোল্ট প্রযুক্তি দ্বারা চালিত। রাইফেলটি স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় মোডে ব্যবহারযোগ্য এবং চরম আবহাওয়াতেও নির্ভরযোগ্য। এর কার্যকরী রেঞ্জ ৩০০-৪০০ মিটার এবং ৩০ রাউন্ডের ম্যাগাজিন ক্যাপাসিটি রয়েছে। সহজ রক্ষণাবেক্ষণ ও বহুমুখী ব্যবহার একে-৪৭ কে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল বানিয়েছে।
একে-৪৭ এর ডিজাইন
একে-৪৭ এর প্রাথমিক ডিজাইন জটিল মেশিনিং এবং প্রযুক্তিকে বাইপাস করে এবং পরিবর্তে একটি শক্তিশালী, সহজ ডিজাইনের উপর নির্ভর করে যা সাধারণত উপলব্ধ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। একে-৪৭ এর ডিজাইন ও এর সৌন্দর্য নান্দনিক। বেশিরভাগই স্ট্যাম্পযুক্ত ধাতব অংশ থেকে তৈরি করা হয়, সাধারণ কাঠের গ্রিপ, বাটস্টোক এবং সামনের গ্রিপ ব্যবহার করে। টেকসই এবং চরম নির্ভরযোগ্যতার উপর ১০০% ফোকাস রেখেই প্রতিটি রাইফেল তৈরি করা হয়।
একে-৪৭ এর ক্ষমতা
আসল একে-৪৭ একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল হিসাবে ডিজাইন করা হয়নি যা সহজেই শত্রুর লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে। এটিকে প্রচলিত মেশিনগানের প্রতিস্থাপন হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল যেগুলি পরিচালনা করার জন্য সাধারণত দুটি অপারেটর প্রয়োজন। ধারণাটি ছিল যে একজন প্রশিক্ষিত সৈনিক ত্রিশ পাউন্ড বন্দুক এবং ভারী রাউন্ড ছাড়া মেশিনগানারের মতোই শত্রুকে গুলি করতে পারে। একে-৪৭ একটি বৃত্তাকার, বাঁকা ম্যাগাজিন ব্যবহার করে যা ৭.৬২x৩৯ এমএম রাউন্ড ধারণ করে। এগুলি ছোট রাউন্ড যা M4 এ ব্যবহৃত ৫.৫৬ এমএম এবং M1 এ ব্যবহৃত ৭.৬২x৫১ এমএম এর মধ্যে পড়ে।
একে-৪৭ এর নির্ভরযোগ্যতা
যদি একে-৪৭ ডিজাইনের একটি বৈশিষ্ট্য থাকে তবে তা হলো এর সহজাত নির্ভরযোগ্যতা, এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও। সৈন্যরা তাদের রাইফেলগুলি মাটির গর্তে ফেলে দেওয়ার, ট্রাক দ্বারা পিষ্ট করার, কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের একে পরিষ্কার করতে "ভুলে" এবং তারা এখনও উদ্দেশ্য অনুসারে কাজ করার অসংখ্য গল্প রয়েছে। সামগ্রিকভাবে একে-৪৭ হলো গ্রহের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অস্ত্র এবং একটি অকেজো হয়ে গেলে এর প্রতিস্থাপন করা অন্যান্য রাইফেলের চেয়ে সাশ্রয়ী। একে-৪৭ একটি অবিশ্বাস্য অস্ত্র এর সমৃদ্ধ ইতিহাস কয়েক দশক ধরে মূল ভিত্তি হিসেবে এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়।
একে-৪৭ এর স্পেসিফিকেশন
- উৎপত্তি: সোভিয়েত ইউনিয়ন
- ডিজাইনার: মিখাইল কালাশনিকভ
- পরিবার: কালাশনিকভ রাইফেল সিরিজ
- ধরন: অ্যাসল্ট রাইফেল
- প্রথম ব্যবহার: ১৯৪৯
- ক্যালিবার: ৭.৬২×৩৯ মিমি
- অপারেটিং সিস্টেম: গ্যাস অপারেটেড, রোটেটিং বোল্ট
- মাস: একে-৪৭: প্রায় ৪.৩ কেজি (লোডেড), একে-এম (আপডেটেড মডেল): প্রায় ৩.৮ কেজি
- দৈর্ঘ: ৮৭০ মিমি (স্টক সহ), ব্যারেল: ৪১৫ মিমি
- গোলাবারুদ ক্ষমতা: ৩০ রাউন্ডের ম্যাগাজিন (৭৫ রাউন্ড ড্রাম ম্যাগাজিনও উপলব্ধ)
- ফায়ার রেট: সেমি-অটো: ৪০ রাউন্ড/মিনিট, ফুল-অটো: ৬০০ রাউন্ড/মিনিট
- এফেকটিভ রেঞ্জ: ৩০০-৪০০ মিটার
- ম্যাক্সিমাম রেঞ্জ: ৮০০ মিটার
- ভিত্তি: সহজে রক্ষণাবেক্ষণ, টেকসই এবং চরম পরিবেশে কার্যক্ষম।
উপসংহার
একে-৪৭ আধুনিক যুদ্ধের বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এটি আমাদের যুদ্ধ করার উপায় পরিবর্তন করেছে। কালাশনিকভের অনন্য নকশা বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি চলমান সংঘর্ষে দেখা যায়। বর্তমানে রাশিয়ানরা আর এই অস্ত্র তৈরি না করলেও আজ এর মৌলিক নকশা বিভিন্ন অস্ত্রের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে চলেছে। এর মূল নকশাটি আরও উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থার পথ তৈরি করেছে। বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে উৎপাদন ও বিতরণের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, অনেক দেশ একে-৪৭ এবং এর অন্যান্য রূপগুলি ব্যবহার করে।
মিখাইল কালাশনিকভ চলে গেছে, কিন্তু তার একে-৪৭ এখনও টিকে আছে। নতুন নতুন আধুনিক অস্ত্রের মাঝেও ৭৭ বছর ধরে, এটি তার সরলতা এবং কার্যকারিতার কারনে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এখনো এটি অন্যতম আক্রমণাত্মক রাইফেল। এত বছর পরও এটি এখনো সহজেই বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত অ্যাসল্ট রাইফেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
- মিখাইল কালাশনিকভ
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments