ভালোবাসার ইমোশনাল স্ট্যাটাস
ভালোবাসা মানেই শুধু মিষ্টি কথা, দোলা লাগা আবেগ কিংবা চিরন্তন প্রতিশ্রুতির গল্প নয়, এর ভেতর লুকিয়ে থাকে বিশ্বাস, ভাঙন এবং কখনো কখনো এমন কিছু মিথ্যা, যা সম্পর্ককে নিঃশেষ করে দেয় ধীরে ধীরে। সম্পর্কের কথোপকথনগুলোতে অনেক সময় আমরা কিছু কথা বলি, শুনি বা বিশ্বাস করি, যেগুলো হয়তো আবেগপ্রবণ, কিন্তু বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এই কথাগুলো অনেক সময় প্রেমের মুখোশের আড়ালে থাকা অসত্য, যা ভালোবাসার পর্দায় ধীরে ধীরে ফাটল ধরায়। আবার এটাও হতে পারে, আবেগজনিত কারনেই ইমোশনাল স্ট্যাটাস বা কথোপকথনে দুজনই দুজনের আরো কাছাকাছি আসে, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয় হোকনা সে স্ট্যাটাস বা কথোপকথন সত্য কিংবা মিথ্যা।
এই নিবন্ধে আমরা তুলে ধরবো এমন দশটি প্রচলিত মিথ্যাচার, যেগুলো আমরা প্রায়ই প্রেমের সম্পর্কে শুনে থাকি, হয়তো অবচেতনভাবে, হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে। আপনি যদি সত্যিকারের ও সৎ একটি সম্পর্ক গড়তে চান, তবে এই মিথ্যাচারগুলোকে চেনা, বোঝা এবং এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি। চলুন, আমরা ভালোবাসার আবেগঘন কথোপকথনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই ছলনার মুখোশ উন্মোচন করি।
![]() |
Symbol of Love | Photo by Feriwala Studio |
১। তোমাকে ছেড়ে যাবোনা কোনদিন
অথচ মাত্র কিছু সংখ্যক প্রেম পূর্ণতা পায় আর বাকীগুলো ঝরে যায়। কেউ না কেউ প্রিয়জনকে একদিন ঠিকই ছেড়ে চলে যায়। সম্পর্ক সবসময় একরকম থাকেনা, একটি সুন্দর স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক ঠুনকো কারনেই এক মুহূর্তেই একটি বিষাক্ত সম্পর্ক হিসেবে পরিবর্তিত হতে পারে। আর পরিশেষে, প্রেম বিচ্ছেদে রূপ নিতে পারে। তাহলে “তোমাকে ছেড়ে যাবোনা কোনদিন” কথাটি একটি মিথ্যা কথা।
২। তোমাকে ভুলতে পারবোনা কোনদিন
এটা একটা কথার কথা। বিচ্ছেদের কিছুদিন পর থেকেই ভালোবাসার ফিলিংস ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং প্রেয়সীকেও ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করে। দিনে একবার, তারপর মাসে একবার, তারপর বছরে একবার, তারপর হঠাৎ কোন বিশেষ মুহূর্তে মনে পরে। সেই সময়কার ফিলিংসটাও ক্ষণস্থায়ী। সে যাইহোক তাকে তো ভুলতে পারা গেছে?
৩। তোমাকে আমার জীবনের চাইতেও বেশী ভালোবাসি
দুর! এ যে যাত্রা বা সিনেমার ডায়লগ। জীবনটা তো সিনেমা নয়, সিনেমা হলে তো রাস্তা, ঘাটে, মাঠে, বনে-জঙ্গলে প্রেমিক-প্রেমিকাকে নাচ-গান করতে দেখা যেতো...😜। বাস্তবতা হলো মানুষ নিজের জীবনের চেয়ে বেশী কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। এটা চিরন্তন সত্য কথা।
৪। তুমি ছাড়া কিছু ভালো লাগেনা
অথচ একটু আগেই পেট পুরে খেয়ে পরম তৃপ্তির ঢেকুর তুলে, হাসতে হাসতে নাটক-সিনেমা দেখে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে অনেক মজা করার পরে প্রিয়জনকে এই ডায়লগ দিচ্ছে...😜।
৫। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবোনা/মরে যাবো
অথচ সময় তাকে মরতে দেয়না, অন্য কারো সাথে রিলেশন অথবা বিয়ে করিয়ে দেয়। ঐ ডায়লগ দেওয়া মানুষটা একদিন বাচ্চাকাচ্চার মুখ তো বটেই নাতী-পুতির মুখ দেখে বুড়ো হয়ে বয়সের ভারে একদিন মরে যায়, সে মরণ কোনমতেই বিচ্ছেদের কারনে নয়।
৬। তোমাকে ছাড়া আর কিছুই চাইনা
আরে অতি আবেগী প্রেমিক...মানুষের বেসিক চাহিদা মানে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান, এইগুলো তো লাগবে নাকি? না খেয়ে, ছেঁড়া জামাকাপড় পরে কি দুইজনে গাছতলায় থাকবি? 😜।
৭। প্রেমে সুখ নেই, শুধু আছে কষ্ট
প্রেমে সুখ আছে বলেই তো মানুষ বারবার প্রেমে পড়ে। প্রেমের কথোপকথনে দুজনের শরীরে ইলেকট্রিক শকের মতো যে তীব্র সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে সেটার কাছে পৃথিবীর অন্যান্য সুখ একেবারে তুচ্ছ। প্রেমে যেমন আবেগ আছে তেমনি আছে যৌনসুখের সুড়সুড়ি, এটা অতি তীব্রমাত্রার সুখ। যদিও বিচ্ছেদের প্রাথমিক অবস্থায় অসহনীয় কষ্ট আছে এটা অস্বীকার করছিনা কিন্তু একটা সময় দেরিতে হলেও কষ্টটা দূর হয়ে যায় এবং তখন হারানো প্রিয়তমকে নিয়ে যৌনচিন্তা করে কিছুটা হলেও সুখের ছোয়া পেতে চেষ্টা করে দুঃখী প্রেমিক। বিঃদ্রঃ প্রেম শুরু হওয়ার পূর্বে প্রিয়তমকে নিয়ে যৌনচিন্তা করা যায়না।
৮। তোমার জায়গায় আর কাউকে বসাতে পারবোনা
এটাও একটা মিথ্যা কথা। বিচ্ছেদ সহনশীল পর্যায়ে গেলে হৃদয়ে শূণ্যস্থান তৈরী হয় সেটা পরবর্তীতে জীবনে কেউ পুনরায় আসলে সেই শূণ্যস্থান পূর্ণ হয়ে যায়। তবে যারা তীব্রমাত্রায় আসক্তির কারনে মানসিক দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে, প্রিয়তমকে হারিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা ফিল করেনা, জীবনের প্রতি মায়া থাকেনা তাদের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য নয়।
৯। আমার চেয়ে বেশী ভালোবাসতে কেউ কোনদিন পারবেনা
এতটা সিউর হয়ে এই আবেগময় কথা বলাটা চাঁপাবাজীর মধ্যে পড়ে। আপনার চেয়েও বেশী আবেগী, বেশী রোমান্টিক, উচ্চমানের প্রেমিক/প্রেমিকা দুনিয়াতে আছে যাদের ভালোবাসার কাছে আপনার ভালোবাসা তুচ্ছ। তাছাড়া মেয়েরা সবসময়ই বেটার অপশন পেতে চায় তাই আপনার চেয়ে বেশী কেউ ভালোবাসতে পারবে কিনা সেটা আপনার সঙ্গী ঠিক বুঝে যাবে, এ ব্যাপারে ওরা ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তাই প্রেমে আলোচ্য উক্তির কোন ভ্যালু নেই। আবার বিরল এক ধরনের প্রেমিক আছে যার ভালোবাসার তীব্রতায় আপনার দশ বছরের কঠিন প্রেমের সমাধি এক মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রেমিকরা হলো প্লেটোনিক প্রেমিক। প্লেটোনিক প্রেমিকের ভালোবাসার কাছে আপনার ভালোবাসা অতি নগন্য। আপনার সঙ্গীকে ঐ ধরনের প্রেমিকের সংস্পর্শে আসতে দিবেন না, তা নাহলে আপনার প্রেম বিচ্ছেদে রূপ নিতে সময় নিবেনা। প্লেটোনিক প্রেম সম্পর্কে জানতে আমার "প্রেমের রহস্যঃ প্রেমের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ" নামক একটা লেখা পোস্ট করা আছে সেটা পড়ে নিবেন।
১০। ভাঙ্গা কাঁচ ও ভাঙ্গা মন কখনো জোড়া লাগেনা
ভাঙ্গা কাঁচ গ্লু, অ্যাডেসিভ টেপ, ইপক্সি ইত্যাদির সাহায্যে জোড়া লাগানো যায়। আবার আমরা জানি কাঁচের গলনাংক ১৫০০ ডিগ্রী সেঃ। কাঁচকে এই তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে কাঁচ গলে যাবে তখন ইচ্ছামতো গড়ন দেয়া যাবে বা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে। কাঁচের মতন মনকেও আগের মতো করে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, তার জন্য চাই নতুন সম্পর্ক। একটি নতুন সম্পর্ক মনের যতো ভাঙ্গা অংশ আছে সব রিপেয়ার করে দিবে, হয়তো মন পূর্বের চেয়ে অধিকতর ভালো অবস্থায় ফিরে যাবে।
বোনাসঃ
১. আমি তোমাকে কখনো কষ্ট দেব না
এই কথাটি যতটা রোমান্টিক শোনায়, বাস্তবে ততটাই অবাস্তব। মানুষ মাত্রই ভুল করে, আবেগে কিছু বলে ফেলে, কোন অশোভন আচরণ প্রকাশ করে, তাতে প্রিয় মানুষ কষ্ট পেতেই পারে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট না দিলেও, সম্পর্কের নানা বাঁকে ভুল বোঝাবুঝি, অপূর্ণ প্রত্যাশা বা নিঃশব্দ দূরত্ব জন্ম নেয়। তাই “আমি কখনো কষ্ট দেব না” এর চেয়ে “তোমার কষ্ট বুঝে পাশে থাকব” এটাই হওয়া উচিত সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি।
২. আমাদের মধ্যে তেমন কিছু হয় নাই
বর্তমান প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিক/প্রেমিকা উভয়েই পূর্বের প্রেমে যৌনাচারের বিষয়টা গোপন করে। এই ব্যাপারে উভয়েই প্রকৃত সত্যের আড়ালে মিথ্যা বলে। "আমাদের মধ্যে তেমন কিছু হয় নাই" বলে দুজনেই অনেক তথ্য গোপন করে। যাইহোক এ ব্যাপারে বেশী কিছু লিখলাম না, কারন এই কথাটির ক্ষেত্রে সত্য বলার গুরুত্ব থাকবেনা তাই এটা গোপন রাখাই ভালো। সৎ যোগাযোগ যদি সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হয় তবে একটু অসৎ হলে ক্ষতি কি? বোনাসের টপিকটি যার প্রথম প্রেম তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
উপসংহার
ভালোবাসার ইমোশনাল স্ট্যাটাস নিয়ে আমরা অনেক কিছুই বললাম। এগুলো মূলত আবেগপ্রবণ মুহূর্তে উচ্চারিত হয়, যেগুলো রোমান্টিক মিথ্যাচার হলেও অনেক সময় সঙ্গীর মনোমনে আনন্দ ও সান্ত্বনা এনে দেয়। সত্যি বলতে, সম্পর্কের কথোপকথনে এই রকম কিছু মিষ্টি মিথ্যা প্রেমের বন্ধনকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এবং কখনো কখনো সম্পর্কের জটিলতা দূর করার পথ তৈরি করে। যদিও এগুলো মিথ্যা বাক্য, তবুও এই কথাগুলো রোমান্টিক ভালোবাসার সম্পর্কের জন্য এক ধরনের গোপন সত্য। কারণ, প্রেমের আবেগে কখনো কখনো সঠিক কথার চেয়ে মধুর কিছু কথাই বেশি কার্যকরী হয়, যা সম্পর্ককে সুন্দর রাখে এবং হৃদয়কে কাছাকাছি নিয়ে আসে।
তবে এর মানে এই নয় যে আমরা সবসময় মিথ্যা বলবো, বরং ভালোবাসার সম্পর্ক যত গভীর হয়, ততই সত্যের জায়গা বাড়ানো উচিত। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সততা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে টেকসই প্রেম, আর সেই প্রেমের মধ্যে এই ছোট ছোট রোমান্টিক মিথ্যাগুলো থাকলেও ভালোবাসা থেকে যায় সত্য এবং শক্তিশালী।
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments